সিলেট নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ নিহতের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত পুলিশের বহিষ্কৃত উপপরিদর্শক আকবর হোসেন ভূঁইয়ার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিলেট চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের বিচারক মো. আবুল কাশেম এ রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। এর আগে এসআই আকবরকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে জানান পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান।
এ মামলায় এ নিয়ে ৪ জনকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া হলো। তবে আগে রিমান্ডে নেওয়া তিনজনের কাছ থেকে বিশেষ কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি পিবিআই। প্রথম দফা ৫ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি না হওয়ায় কনস্টেবল টিটুচন্দ্র দাস ও হারুনুর রশীদকে দ্বিতীয় দফায় আরও ৩ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হলেও তারা নির্যাতনের দায় স্বীকার করেননি। অপর ব্যক্তি এএসআই আশেক এলাহী ৫ দিনের রিমান্ড চলাকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তিনিও দায় স্বীকার করেননি।
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর এ মামলার তদন্ত শুরু থেকেই হোঁচট খাচ্ছে। মামলা তদন্তে প্রধান বাধা ছিল এসআই আকবর গ্রেপ্তার না হওয়া। তবে দুই সপ্তাহের মধ্যেই মামলার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে বলে গত ২ নভেম্বর হাইকোর্টকে জানিয়েছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী। উল্লিখিত সময় শেষ হচ্ছে ১৬ নভেম্বর। তখনো রিমান্ডে থাকবেন আকবর। স্বাভাবিকভাবেই শেষ হচ্ছে না তদন্ত।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যেই তদন্ত শেষ করা হবে। তবে আকবর গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়ার কারণে কিছুটা দেরি হতে পারে।
নাম জানা যায়নি সেই সিনিয়র কর্মকর্তার
রায়হানের মৃত্যুর দিনই ঘটনা তদন্তে মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-উত্তর) আজবাহার আলী শেখের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন এসএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি ক্রাইম দক্ষিণ) এহসানুদ্দিন চৌধুরী, এডিসি ক্রাইম উত্তর শাহরিয়ার আল মামুন ও সহকারী কমিশনার (এসি এয়ারপোর্ট) প্রভাশ কুমার সিং। তদন্তে ফাঁড়িতে নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টি সামনে আসার পর বরখাস্ত হন ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর হোসেন ভূঁঁইয়াসহ ফাঁড়ির চার পুলিশ সদস্য। ফাঁড়ির আরও তিন সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু সিনিয়র কর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ আর নজরদারির মধ্যেই পালিয়ে যান প্রধান অভিযুক্ত ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর হোসেন ভূঁঁইয়া। সে সময় তাকে পালানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিলেট কোতোয়ালি থানার এসআই আবদুল বাতেনও আকবরকে আটকের বিষয়ে গুরুত্ব দেননি।
বিষয়টি তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এআইজি (ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগ) মুহাম্মদ আয়ুবের নেতৃত্বে একটি দল সিলেট সফর করে। এ তদন্ত বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে এর পর বরখাস্ত করা হয় বন্দরবাজার ফাঁড়ির দ্বিতীয় ইনচার্জ হাসান উদ্দিনকে।
পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রিমান্ডে আকবরের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সব অভিযোগের তদন্ত করে দেখা হবে।
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িটি মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানার অধীন। থানার অধীনে আকবরের সিনিয়র কর্মকর্তা হচ্ছেন কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও সহকারী কমিশনার (এসি)।
জেলা পুলিশের তৎপরতাতেই আটক হন আকবর
গত সোমবার আকবরকে গ্রেপ্তারের পর সিলেটের পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন ও সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মো. মফিজ উদ্দিন দাবি করেন, কানাইঘাট সীমান্ত থেকে আকবরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে আটক করা হয় বলে দাবি করা হলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নে পুলিশ সুপার বলেন, এমনো হতে পারে যে সে ভারতের সীমান্ত এলাকায় কোথাও আত্মগোপনের পর দেশে প্রবেশের চেষ্টার সময় আটক হয়। কিন্তু পুরো বিষয়টিই করা হচ্ছিল গোয়েন্দা তৎপরতা ও বিস্বস্ত সোর্সের মাধ্যমে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে আকবরকে আটককারী খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনকে হিন্দিঘেঁষা সিলেটি ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়। তাকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলেও ভয় দেখানো হয়। সে জন্য ধারণা করা হচ্ছে ভিডিওটি ভারত সীমান্তের। সেখানে আকবরকে বেঁধে নিয়ে আসতে উদ্যোগী এক লোককে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়। তাকে কয়েকবার ‘ওসি’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে শোনা যায়। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, এই ব্যক্তি পুলিশের সোর্স। ভারত সীমান্তে পালিয়ে থাকা অবস্থায় সোর্সের মাধ্যমে ও খাসিয়াদের সহযোগিতায় কৌশলে ও ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে এসে আকবরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আকবরকে গ্রেপ্তারে পুলিশের নানামুখী তৎপরতা ছিল দাবি করে পুলিশ সুপার বলেন, তাকে বিশ্বস্ত বন্ধুদের মাধ্যমে আটক করা হয়। সে নানা জায়গায় পালিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল। যখন যেভাবে সম্ভব তার আশ্রয়দাতাদের আমরা শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। এ কৌশল কাজে লাগিয়েই আমরা কানাইঘাট সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।