বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘু চাপ ও অমাবস্যার জোর প্রভাবে গত এক সপ্তাহ ধরে জোয়ারের পানিতে থৈ থৈ করছে পটুয়াখালীর উপকূলের জনপদ। পানিবন্দি হয়ে আছে কয়েক লাখ মানুষ। এমনি একটি জনপদ জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের কলাউপাড়া গ্রাম।
এ গ্রামের সব মানুষজনই কোমর সমান পানির মধ্যে বসবাস করছেন। বাড়ির অঙিনা, উঠান ঘরের ভিতরসহ সবখানেই পানি আর পানি। এক কথায় পুরো গ্রামটিই জোয়ারের পানিতে ভাসছে। তা সত্ত্বেও থেমে ছিল না একটি পরিবারের বিয়ের বর-কনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। কোমর সমান পানিতেই আয়োজন করা হয় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটি।
গত শনিবার দুপুরে ছেলের বাড়িতে এ গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পানির মধ্যে বর-কনের গায়ে হলুদের এই ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানটির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এর শুরু হয় আলোচনার ঝড়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন ফকির গত ২৯ জুলাই বিয়ে করেন জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের গাববুনিয়া গ্রামের মো. হান্নান সিকদারের মেয়ে তামান্না আক্তারকে। এই বৈরি আবহাওয়ার মধ্যে গত ২০ আগস্ট নববধূকে নিজ বাড়িতে তুলে আনেন তিনি এবং ২২ আগস্ট দুপুরে প্লাবিত জোয়ারের পানির মধ্যে বর-কনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করে ছেলে পক্ষ।
জোয়ারের পানিতে চারদিক যখন থৈ থৈ করছে, তখন মহিউদ্দিনের পরিবার বাড়ির উঠানে চেয়ার পেতে বর-কনেকে গায়ে হলুদ দেওয়া হয়। কোমর সমান পানি উপেক্ষা করে এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয় মহিউদ্দিনের নিকট আত্মীয়স্বজন। ওই পানির মধ্যেই চলে বর মহিউদ্দিন ফকির ও কনে তামান্না আক্তারের গায়ে হলুদের আনন্দ-উৎসব।
জোয়ারের পানির মধ্যে ব্যতিক্রমী গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের আয়োজন সবাইকে আকৃষ্ট করেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা শিক্ষার্থী মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘আমাদের সুখ-শান্তি কিছুই নাই। একটি জনপদ সব সময় পানিতে ডুবে থাকে, আর তা নিয়ে কারও মাথা ব্যাথা নেই। এটা কিভাবে হতে পারে? জীবনকে তো থামিয়ে রাখা যাবে না। জীবন চলবেই। যার কারণে এ রকম একটি আয়োজন করতে হয়েছে। এটা সুখের সঙ্গে কষ্টের ও বেদনার কিছু চিত্র বহন করছে’।
বর মহিউদ্দিন ফকিরের বাবা আবদুল বারেক ফকির বলেন, ‘কী করমু কন? ঘরে পানি, বাইরে পানি। নাইম্যা কোথাও যে যামু, হেই অবস্থাডাও নাই। বাধ্য হইয়াই বাড়ির উডানে বর-কনের গায়ে হলুদের এই আয়োজন করতে হইছে। সব আত্মীয়স্বজন কাউকেই তেমন দাওয়াত করতে পারি নাই। আমাদের এই আনন্দের ও সুখের দিনেও কষ্টের মধ্যেও জীবন কাটাতে হচ্ছে’।
এ ব্যাপারে কলাপাড়ার লালুয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো. শওকত হোসেন বিশ্বাস জানান, এ ঘটনাটি আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আমাদের লালুয়াবাসির জন্য দুর্ভাগ্য। আজকে একটি পরিবারের এই আনন্দ ও খুশির দিনটিও সীমাহীন কষ্টের মধ্যে অতিক্রম করতে হচ্ছে। বিয়ের বর-কনের গায়ে হলুদের মতো একটি অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে কোমর সমান পানির মধ্যে। এর চেয়ে আমাদের আর বড় দুর্ভাগ্য কী হতে পারে? বছরের ১২ মাসের আট মাসই থাকতে হয় পানির মধ্যে। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন সবাইকেই লালুয়ার বেড়িবাঁধের জন্য বলা হয়। সবাই শুধু কথা দেয়, আশ্বাস দেয়। কিন্তু কাজের কাজ আজ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। জানি না আরও কত পরিবারের বিয়ে-অনুষ্ঠান এভাবে পানির মধ্যে করতে হয়?