বিতরণ লাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে নারায়ণগঞ্জের মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আর ওই বিতরণ লাইন ছিল তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের। সেই লাইন দিয়ে তিতাসই গ্রাহকের জন্য গ্যাস সরবরাহ করছিলো। কিন্তু দুর্ঘটনার পর তিতাস যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে নিজেদের সব দায় কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিতরণ লাইনের দেখভালের দায়িত্ব তিতাসের। সাধারণ জনগণ তাদের পাইপ লাইন দেখে রাখবে, এমনটি সব ক্ষেত্রেই ঠিক নাও হতে পারে। তাই ঘটনার দায় তিতাসকেই নিতেই হবে।
গত বৃহস্পতিবার বিকালে তদন্ত কমিটির প্রধানকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিতাসের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী আবুল ওহাব তিতাসের কোনও দায় খুঁজে পাননি বলে জানান।
তিতাসের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল মামুন বলেন, কেউ আমাদের অভিযোগ করেছে আর আমরা পাইপ লাইন সংস্কার করিনি, এমনটি কোথাও ঘটেনি।
তবে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, তিতাস কর্তৃপক্ষের কথার অর্থ কি, কেবল তিতাস অভিযোগ পেলেই সেখানে ছুটে যাবে? অভিযোগ না করলে তিতাস তাদের পাইপ লাইনের আর কোনও খোঁজ রাখবে না? কীভাবে তাদের পাইপ লাইনটি রয়েছে, এর ওপর কেউ ইমারত নির্মাণ করেছে কিনা, তা দেখবে না?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিতাসের পাইপ লাইনের একটি নির্দিষ্ট ড্রয়িং রয়েছে। এই ড্রয়িং ধরে বছরে একবারও যদি দেখা হয়, তাদের পাইপ লাইনের ওপর কেউ বিল্ডিং করছে কিনা, মাটি খুঁড়ে পাইপ লাইন উন্মুক্ত করেছে কিনা, তাহলেই তাদের পাইপ লাইনটি কী অবস্থায় রয়েছে বোঝা সম্ভব।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, শুধু মসজিদ কমিটি আর গ্রাহকের ঘাড়ে দোষ দিলে হবে না। লাইন থেকে যে লিকেজ হচ্ছে সেটা না জানাটাও তিতাসের অপরাধ। তিতাসের উচিত গ্যাস লাইন স্থাপনের পর একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর সে লাইনের কী অবস্থা তার খোঁজ রাখা। পাশাপাশি লাইনে কোনও লিকেজ পেলে সে বিষয়ে সতর্ক করাও তিতাসের কাজ। সাধারণ গ্রাহক অনেক সময় বিষয়গুলোকে এত গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।
তিনি আরও বলেন, তিতাস দায় না এড়িয়ে এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের পাইপলাইনের লিকেজগুলো খুঁজে বের করে মেরামত এবং এখন মেরামত করা না গেলেও চিহ্নিত করে এলাকার আশপাশের মানুষকে সতর্ক করার ব্যবস্থা নিতে পারে। নইলে বার বার এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে নারায়ণগঞ্জের ওই এলাকায় গ্যাস সরবরাহ শুরু করে তিতাস। আর ১৯৯৬ সালে মসজিদটি নির্মাণ হয়। তখন তিতাসের পাইপ লাইনের ওপর মসজিদের বেইজমেন্টের ঢালাই করার সময় পাইপ লাইনের ক্ষতি হয়। আর দুর্ঘটনা ঘটে এর ৩৪ বছর পর অর্থাৎ ২০২০ সালে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন উঠেছে প্রতি বছরতো দূরের কথা, গত ৩৪ বছরেও কি একবারও তিতাসের উচিত ছিল না তাদের পাইপ লাইনের খোঁজ নেওয়া?
লিকেজ থেকে গ্যাস বের হওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটেক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, তিতাস নিজের অভিযোগ নিজেই তদন্ত করেছে। এতে তদন্ত কতখানি হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। অভিযুক্তরাই যদি তদন্ত করে তো সেই তদন্ত প্রতিবেদনে সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়। একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত ছিল।
তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে নারায়ণগঞ্জ এর অধীন এলাকার পাইপলাইন পরীক্ষা, লিকেজ শনাক্ত করা এবং মেরামত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর সেগুলো পরিদর্শনের কথাও সুপারিশে বলা হয়েছে। এর অর্থ তারা রুটিন কাজ হিসেবে লিকেজ পরীক্ষা করে না। পাইপলাইনের লিকেজের বিষয়ে কিছুই তারা জানে না। নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ করে না। অথচ দেশ জুড়েই অবৈধ লাইনের অভিযোগ। তারা অভিযান চালিয়ে এসব লাইন অপসারণ করছে, আবার তা রাতারাতি স্থাপনও হয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে প্রায় ২৮৯ কিলোমিটার অবৈধ লাইন আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই বিস্তর অবৈধ লাইনের বিষয়ে তিতাস গ্যাসের নারায়ণগঞ্জ অফিস কিছুই জানে না?
তিনি বলেন, তাদের এই প্রতিবেদন নিরপেক্ষ হয়নি। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এ বিষয়ে তদন্ত করছে। শিগগিরই তা প্রকাশ করা হবে। আমরা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচার চাই।
কারও অবহেলায় সাধারণ মানুষের জীবন যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে এর জন্য দোষীদের কঠিন শাস্তি দাবি করেন তিনি।