মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী, জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গোমড়া এলাকায় ফারহানা আক্তার (২৫) নামে দুই সন্তানের জননী এক গৃহবধূ’র রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সদর উপজেলার ১২নং গিয়াসনগর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের গোমরা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
সংবাদ পেয়ে মৌলভীবাজার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জিয়াউর রহমান ও সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিনুল হকসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগন ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে গৃহবধূ’র স্বামী রুমেল আহমেদ (৩০), শশুর মাওলানা হোসাইন আহমদ (৬৫) ও নিহতের শাশুড়ি জেসমিন বেগম(৫৫) কে প্রথমেই থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
নিহত ওই নারীর স্বামী রুমেল আহমদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রুমেল আহমদের স্ত্রী মাসখানিক পূর্বে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সন্তান জন্মের পর থেকে কিছুটা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন ওই নারী।
বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে তাঁর শরীরে খিচুনী হলে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে স্বামী রুমেল আহমদ তার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষনা করেন।
মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে নিহত ফারহানা আক্তারের পিতাকে অনুমান সাড়ে ৫টার দিকে স্বামী রুবেল আহমদ তার শাশুড়ির নাম্বারে কল করে জানান উনার মেয়ের অবস্থা ভাল না। বিষয়টি অবগত করে সিএনজি যোগে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নিহত ফারহানা আক্তারকে মৃত ঘোষনা করলে লাশ স্বামী রুমেল আহমদের ১২ নং গিয়াসনগর ইউনিয়নের গোমড়া নিজ বাড়িতে নিয়ে যান এবং মুঠোফোনে নিহত ফারহানা আক্তারের বাবাকে মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হয়।
এদিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া ৩৮দিনের বাচ্চাসহ দুই সন্তানের জননী এ নারীর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে এলাকায় চলছে বেশ গুঞ্জণ। সরেজমিনে গোমড়া এলাকার ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার শামসুল ইসলামসহ স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, বিয়ের পর থেকে তাদের মধ্যে দ্বন্ধ লেগেই থাকতো এবং এবিষয়ে বেশ কয়েকবার শালিস বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্বামী রুমেল প্রায় সমই স্ত্রীকে মারধর করত বলেও জানা যায় । দ্বন্ধের কারনে বেশ কয়েকবার সালিশ বৈঠক হলেও এসব ব্যর্থ হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান ফারহানার ২য় সন্তান গত ৩৯দিন পূর্বে সন্তান প্রসবের পরও স্বামী রুমেল আহমদ স্ত্রীর উপর নির্যাতন করে। নাম প্রকাশ্য না করার শর্তে প্রতিবেশী কয়েকজন জানান, শুধু খিচুনীর কারনে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে সেটা বিশ্বাস করতে পারছি না ।
থানায় দায়ের করা অভিযোগ সূত্রে আরো জানা যায়, গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ইং তারিখে রাতে ফারহানা স্বামীর বাড়ির মুঠোফোন থেকে বাবার বাড়িতে কল করে জানায় তাকে স্বামী রুমেল আহমদসহ বর্ণিত আসামীগন তাকে মারধর করছে। নিহত ফারহানার পিতা সন্জব আলী পরের দিন মেয়ের শশুর বাড়িতে অনুমান দুপুর ১ঘটিকার দিকে মেয়ের সাথে দেখা করতে গেলে ফারহানার শশুর ২নং আসামী হোসাইন আহমদ ফারহানার পিতার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে আসেন এবং গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। মেয়ের সাথে দেখা করতে দেননি বলে জানান। এর দুদিন পর ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ইং সকাল অনুমান সাড়ে ৬:০০ ঘটিকায় সময় মুঠোফোনের মাধ্যমে ফারহানার পরিবারকে জানানো হয় ফারহানা মারা গেছে।
সংবাদ পেয়ে সঞ্জব আলীসহ পরিবারের লোকজনসহ মানবাধিকার কর্মী মিসেস ফাতেমা পপিসহ নিহত ফারহানা আক্তারের শশুর বাড়িতে পৌছালে বাড়ির সামনের কক্ষে মেয়ের লাশ দেখতে পান ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাছাড়া নিহত ফারহানার এক কানে দুল আছে অপর কানে দুল নেই বলে জানান। অভিযোগ সূত্রে আরো জানা যায়, বিয়ের পর থেকে নিহত ফারহানা আক্তারের কাছে বেশ কয়েকবার যৌতুক হিসেবে চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন সময়ে ৪লক্ষ টাকা গ্রহন করে। এর পরবর্তীতে গত ১ সেপ্টেম্বর ইং তারিখে ব্যবসা করার কথা বলে ৭লক্ষ টাকা যৌতুক চেয়েছিল।
নিহত ফারহানার পিতা সঞ্জব আলী অপারগতা প্রকাশ করার কারনে অভিযোগে উল্লেখিত বর্ণিত আসামীগণের বিরুদ্ধে ১। স্বামী – রুমেল আহমদ (৩০) ২। শশুর- হোসেন আহমদ (৬৫) ৩। শাশুড়ি – জেসমিন বেগম (৫৫) – স্বামী হোসাইন আহমদ ৪। ননদ – সীমা বেগম, পিতা হোসাইন আহমদ সর্ব সাং – গোমড়া, থানা ও জেলা মৌলভীবাজার সহ অজ্ঞাত নামা আরো ২জনকে আসামী করে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ইং তারিখে মামলা দায়ের করা হয় । মামলার ১নং আসামী নিহতের স্বামী রুমেল আহমদ, ২নং আসামী শশুর হোসাইন আহমদ ও ৩নং আসামী শাশুড়ি – জেসমিন বেগম গ্রেফতার পূর্বক বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মামলার ৪নং আসামী ননদ সীমা বেগম ও অজ্ঞাত আসামীগণ পলাতক রয়েছে। নিহত ফারহানা আক্তারের বাবা আরো বলেন , আমি যৌতুক দিতে অপারগতা প্রকাশ করা ও পূর্ব থেকে নির্যাতন করে আসছিল যার ঘটনার সাক্ষী রয়েছে। তা থেকে আমার ধারনা আমার মেয়েকে নির্যাতন করে বর্ণিত আসামীগন ফারহানাকে হত্যা করেছে। উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি আমার মেয়ে ফারহানা আক্তারের হত্যার বিচার চাই।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার মডেল থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) ইয়াছিনুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, খবর পেয়ে পুলিশ গোমড়া ফারহানার স্বামীর বাড়ি পরিদর্শন করে লাশ উদ্ধার করে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় শরীরে আঘাতের চিহৃ পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর বলা যাবে এটা হত্যা না কি আত্মহত্যা।
উল্লেখ্য: মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের খলিলপুর গ্রামের কুয়েত প্রবাসী সঞ্জব আলীর মেয়ে ফারহানা আক্তারের সাথে বর্তমান ১২ নং গিয়াসনগর ইউপির ৭নং ওয়ার্ডের হোসাইন আহমদের ছেলে রুমেল আহমদের সাথে গত ১৩/১১/ ২০১৪ ইং সালে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে স্বামী ও শশুর বাড়ির লোকজনের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল এবং এ নিয়ে বহুবার শালিস বৈঠক হয়েছে বলে জানা যায়।