করোনাকালে বিশ্বের সব দেশই কমবেশি অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। করোনা পরবর্তী স্থবিরতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে দেশে। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে রপ্তানি আয়। তবে বর্তমানে আমদানি বাড়ায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে বাণিজ্য ঘাটতি। এরসঙ্গে আকস্মিক মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্সে ধীর গতি, বিদেশি ঋণের চাপ এবং রিজার্ভে টান পড়ার শঙ্কায় চাপে পড়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে বেড়ে গেছে আমদানি পণ্যের দাম। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশের সব ধরনের জিনিসপত্রের মূল্য। দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারকে দিতে হচ্ছে ভর্তুকি। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে গেছে অনেক বেশি।
বেড়েছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে হাঁপিয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। ডলারের বিপরীতে কমে গেছে টাকার মান। এসব কারণে অর্থনীতিতে বিপদ সংকেত দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গত দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে জটিল অবস্থার মধ্যে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। যা সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় দেশের মূল্যস্ফীতির ভেতর দিয়ে। গত দেড় বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। যা এখন অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া করোনাকালে সৃষ্ট সংকট থেকে এখনো সম্পূর্ণরূপে উত্তরণ ঘটানো যায়নি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আসছে নতুন অর্থবছরের বাজেট। কিন্তু এবারের বাজেটের বড় অংশই চলে যাবে শুধু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে। সবমিলিয়ে সামনে আরও বিপদের মুখে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি- এমনটিই মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাই সংকট থেকে উত্তরণে বাজেটকে সামনে রেখে এখনই করণীয় ঠিক করার পরামর্শ তাদের।
আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক: দেশে রপ্তানি আয় বাড়লেও আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। চলতি অর্থবছরে (জুলাই-মার্চ) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। তবে রপ্তানির তুলনায় ব্যাপক হারে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ও বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি পড়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। এই ৯ মাসের বাণিজ্য ঘাটতি গত অর্থবছরের পুরো সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-মার্চ সময়ের চেয়ে বেশি প্রায় ৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ ব্যাপক বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশ করা বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৬১.৫২ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। এ হিসাবে অর্থবছরের ৯ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।
টাকার মান কমেছে ইতিহাসে সর্বোচ্চ: দেশে আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাড়ছে ডলারের চাহিদা। ফলে বাড়ছে ডলারের দাম, বিপরীতে কমছে টাকার মান। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ কমেছে টাকার দর। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেও টাকার দর ধরে রাখতে পারছে না। আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোও অনানুষ্ঠানিক বাজার থেকে ডলার কিনছে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে এখন ব্যাপক অস্থিরতা চলছে। মে মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৃতীয় বারের মতো ডলারের দর নির্ধারণ করেছে ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু পণ্য আমদানির জন্য ৯৫ থেকে ৯৮ টাকার নিচে বিক্রি করছে না ব্যাংকগুলো। আর খোলাবাজারে ডলারের দাম অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন। গত ১৭ই মে বাড়তে বাড়তে ১০৪ টাকা পর্যন্ত উঠে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংক মৌখিকভাবে ব্যাংকগুলোকে ডলারের দর নির্ধারণ করে দিলেও কোনো ব্যাংক তা মানছে না। আবার বেশি টাকার আশায় এক ব্যাংকের গ্রাহক অন্য ব্যাংকের কাছে ডলার দিয়ে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি।
বাড়ছে মূল্যস্ফীতি: খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হলেও অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর। আমদানি খরচ বাড়ায় এসব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চিনি, গম, সার, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির। এর প্রভাবে বাজারে ভোজ্য তেল, চাল, আটা, ময়দা, চিনির দাম উচ্চ হারে বেড়েছে। আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। বর্তমানে এমন কোনো পণ্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেটির দাম বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির এই প্রভাব জেঁকে বসেছে মানুষের সার্বিক জীবন যাত্রায়। প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। যা গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি: করোনাকালে রেমিট্যান্স বাড়লেও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হোঁচট খায় রেমিট্যান্স প্রবাহে। ওই মাসে ১৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। তার আগের মাস মার্চ মাসে এসেছিল ১৮৬ কোটি ডলার। তবে সদ্যসমাপ্ত এপ্রিল মাসে ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওই বছরের এপ্রিলে মাত্র ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। এর পর থেকে অবশ্য মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরোটা সময়ে (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন দেখা যায়। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়ে। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। অক্টোবরে আসে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে আসে আরও কম, ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবে এখনো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে রেমিট্যান্স। এই দশ মাসে ১ হাজার ৭৩০ কোটি ৭৭ লাখ (১৭.৩০ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ২ হাজার ৬৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার (২০.৬৬ বিলিয়ন) ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যে পরিস্থিতি: আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কম হওয়ায় বিগত দিনে কমের দিকে ছিল রিজার্ভ। তবে গত আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর গত ৯ই মে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারে। আর ১০ই মে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) প্রায় ২২৪ কোটি ডলার পরিশোধের পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে। এরমধ্যে বড় আমদানি ব্যয় পরিশোধের কারণে কমে যাওয়া রিজার্ভ আবারও কিছুটা বৃদ্ধি পায়। নতুন করে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার যুক্ত হওয়ায় রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে।
বিদেশি ঋণের চাপ: দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য বিদেশ থেকে অনেক ঋণ নেয়া হয়েছে। যা পরিশোধ করতে চাপে পড়তে পারে সরকার। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলার করে ঋণ বাড়ছে সরকারের। ০.৭ বিলিয়ন ডলার করে প্রতিবছর দেনা পরিশোধ করতে ব্যয় করতে হচ্ছে। এরমধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধির হার খুবই বেশি; ৬৯ বিলিয়ন ডলার। গত এক দশকে ওই ঋণ বৃদ্ধির হার প্রায় ৫৪ শতাংশ। ২০১৩ সালের পরে এই বৃদ্ধি হার ১৫ থেকে ১৯ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৬০.১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের ১৬.৬ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ এবং ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪.৭ থেকে ১৬.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণের সুদ পরিশোধের হিসাব করলে দেখা যায়, ২০০৬ সালে বৈদেশিক সুদ পরিশোধ করা লাগতো ৩৮.৯১ শতাংশ ও অভ্যন্তরীণ ৬১.০৯ শতাংশ। যা ২০১৩ সালের পর ঋণ বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এসে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় করতে হয়েছে ৬৭.৬৫ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৩২.৩৫ শতাংশ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে।
যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা: বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, আগামী তিন বছর পর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পরে বাংলাদেশ বৈদেশিক দায়- দেনায় অস্বস্তিকর অবস্থানে চলে যেতে পারে। বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিশ্বব্যাংক, জাপানসহ প্রথাগতভাবে যারা কম সুদে ঋণ দিতো, তারাও এখন তুলনামূলক বেশি সুদ নিচ্ছে। সুতরাং স্বস্তির জায়গাটা কমে আসছে। এখন আমরা বিদেশি দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে বেশি মূল্যে বেশি ঋণ করছি। যেমন; চীন, রাশিয়া ও ভারত। এসব দেশের ঋণের রেয়াতি সময় (গ্রেস পিরিয়ড) শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশি ও বিদেশি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, বিদেশি দায়-দেনার দেশি উৎসের দায়-দেনাও কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার মতে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে তুলনামূলক বেশি সুদে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গত তিন বছরে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি-দুই উৎস থেকেই ঋণ নেয়া বেড়েছে। আবার গত দু’টি জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর, নির্বাচনের বছর ও পরের বছর ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
উন্নয়ন ও অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান বলছেন, সমস্যা তৈরি হতে পারে আমদানির দায় মেটাতে। কারণ, ক্রম বৃদ্ধি পাওয়া ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের (লেনদেনে ভারসাম্য) ঘাটতিতে ২০২৫ নয়, চলতি বছরেই একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ক্যাপিটাল কন্ট্রোলের কারণে ভোগ ব্যয় কমে আসা, অর্থ প্রবাহ কমে আসা, সরকারের ঋণের সুযোগ কমে আসা সহ অর্থনীতিতে বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া হবে। ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের ঘাটতি মেটাতে সৃষ্ট এই পদক্ষেপগুলোই অর্থনীতিতে বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। আগামী দুই থেকে তিন বছরে নতুন কিছু চাপ যুক্ত হবে যার প্রভাব এখনো অজানা। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ বর্তমানে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। আগামী বছরগুলোতে অর্থনীতিতে আরও কিছু বৈদেশিক ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হবে। বাংলাদেশ তার ভোজ্য তেল, গম ও মশলার প্রায় পুরোটাই আমদানি করে। ফলে, এই পণ্যগুলোতে আমদানিতে ঊর্ধ্বমুখী ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে চাপটা আগামী বছরগুলোতে চলমান থাকবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় এ বছর অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আমাদের আমদানি ব্যয় এবার ৮ হাজার কোটি ডলার ছাড়াবে। কিন্তু আমাদের রপ্তানি আয় ৫ হাজার কোটি ডলার। এখানে ৩ হাজার কোটি ডলার বা তারও বেশি বাণিজ্য ঘাটতি হতে যাচ্ছে। এই ৩ হাজার কোটি ডলার ব্যয় আমরা হয়তো রেমিট্যান্স দিয়ে মেটাতে পারবো, কিন্তু বাকি ১ হাজার কোটি ডলার বা তারও বেশি যা লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে ঘাটতির সৃষ্টি হবে। ফলে ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক যা নির্ধারণ করে দেয় তার চেয়ে বাজারে প্রায় ১০-১২ টাকা বেশি হয়ে যায়।
একইসাথে আমাদের রিজার্ভ গত ৮ মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। রিজার্ভ কমার প্রবণতা যদি গেড়ে বসে তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপদে পড়বে। আর সেটার প্রধান কারণ হলো- আমরাও শ্রীলঙ্কার মতো মেগা প্রকল্পগুলোতে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছি যেগুলো আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে কিস্তিতে শোধ করা শুরু হয়ে যাবে। তখন এই ঋণ শোধের কিস্তি অনেক বেড়ে যাবে। ফলে আগামী বাজেটের অনেক বড় একটি অংশ এই ঋণ পরিশোধের কিস্তি হিসেবে বিদেশে চলে যাবে। এসব বাস্তবতার কারণে আমরা যদি কঠোর হাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি এবং বাণিজ্য ঘাটতি যদি কমাতে না পারি তাহলে সামনে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপদে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। বর্তমানে অর্থনীতিতে চাপ বাড়ার এগুলোই প্রধান কারণ বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
মইনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বিদেশে পুঁজি পাচার বাড়ছে। হুন্ডির পদ্ধতি আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে গেছে। ফলে আমাদের রেমিট্যান্স এখন বৈধ পথে না এসে হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। এর ফলে ঋণ খেলাপিও বেড়ে যাবে দিনদিন। এটা ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য একটা বিপদ ডেকে আনবে। তিনি বলেন, রিজার্ভের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত বিদেশে বিনিয়োগ যোগ-বিয়োগ করে জুন মাসে হয়তো প্রায় ৫-৬ বিলিয়ন রিজার্ভ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখন ইমিডিয়েট কোনো বিপদ হবে না, তবে এভাবে যদি প্রত্যেক বছরে ৫-৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমে যেতে শুরু করে তাহলে এই রিজার্ভ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আসতে বেশি দিন লাগবে না। কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশেও রিজার্ভ বিপজ্জনক অবস্থায় চলে আসতে পারে। এর সাথে পুঁজি পাচার অনেক বেড়ে যাচ্ছে, আর দুর্নীতি তো এক নম্বর সমস্যা আছেই।