ইউরোপিয়ান কমিশন সম্প্রতি জানিয়েছে যে ইরাক, গাম্বিয়া ও বাংলাদেশে থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশের জন্য স্বল্পমেয়াদী ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কড়াকড়ি আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে৷ কী কারণে এই প্রস্তাবিত কড়াকড়ি তা জানতে গণমাধ্যম কথা বলেছে ইউরোপিয়ান কমিশনের সাথে।
চলতি বছরের ১৫ জুলাই ইউরোপিয়ান কমিশন এক বিবৃতিতে জানায় যে ইরাক, গাম্বিয়া ও বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বল্পমেয়াদি ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে কিছুদিনের জন্য কড়াকড়ি আরোপ করতে চায় ইউরোপের দেশগুলোর জোটটি। এই বিষয়ে ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত কড়াকড়ি ‘টেম্পোরারি’ বা সাময়িক হলেও তা ঠিক কতদিনের জন্য সেটা বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
এই বিষয়ে আরো জানতে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে ইউরোপিয়ান কমিশনের অভিবাসন ও স্বরাষ্ট্র বিষয়ক দপ্তরের প্রেস বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হয়।
কেন কড়াকড়ি?
২০১৯ সালের পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ২০২০ সালের সংশোধিত ভিসাবিধিকে মাথায় রেখে দেখা গেছে যে বাংলাদেশের পক্ষে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি ইউরোপে বসবাসকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত নেওয়ার কাজে। ইউরোপে থাকার বৈধ অনুমতি বা সংশ্লিষ্ট নথি না থাকা বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠানোর কাজে (রিঅ্যাডমিশন) বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে এমন সিদ্ধান্তে এসেছে বলে ইউরোপিয়ান কমিশন আগেই বিবৃতিতে জানিয়েছিল৷
ইউরোপীয় কমিশনের স্বরাষ্ট্র ও অভিবাসন দপ্তর এই বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানান, বাংলাদেশ থেকে আসা বেশিরভাগ অনিয়মিত অভিবাসনপ্রত্যাশী আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রদানের আওতায় পড়েন না বলে তাদের নিজদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। এদের বেশিরভাগেরই অভিবাসনের উদ্দেশ্য থাকে মূলত অর্থনৈতিক।
এছাড়া, ২০১৭ সালে বৈধ কাগজহীন বাংলাদেশিদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউ’র স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি হয়৷ এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদান-প্রদান এবং জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিক থেকে আরো তৎপর পদক্ষেপের প্রত্যাশা করছে ইউরোপ। ২০২০ সালের সংশোধিত ভিসা কোডেই বলা ছিল, যেসব রাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের ফেরত নেবার ক্ষেত্রে (রিঅ্যাডমিশন) সহায়তা করবে না, তাদের জন্য ভিসা কড়াকড়ি আরোপ করা হবে।
সেই ধারা থেকেই এই প্রস্তাব এসেছে বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে ইইউ কর্তৃপক্ষ।
কী কী কড়াকড়ি?
প্রস্তাবিত কড়াকড়ি আওতায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের স্বল্পমেয়াদী বা শর্ট-টার্ম ভিসার আবেদনের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনতে চায় ইউরোপিয়ান কমিশন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
– কিছু বিশেষ বিভাগের আবেদনকারীরা বিশেষ নথি জমা দেবার ক্ষেত্রে ছাড় পাবেন না
– ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টধারী ব্যক্তিরা ভিসা ফি মওকুফের সুবিধা পাবেন না
– আগের মতো ১৫ দিনের মধ্যে ভিসার আবেদনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত জানার সুবিধা থাকবে না
– মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসার সুবিধা, যা দীর্ঘ সময়ের জন্য বৈধ ছিল, আর থাকবে না
এবিষয়ে ইউরোপিয়ান কমিশন জানায় যে আগে কিছু বাংলাদেশিরা ভিসার আবেদনের সময় কিছু বিশেষ নথি দেখানোর ক্ষেত্রে ছাড় পেতেন। উদাহরণস্বরূপ, সেই সব আবেদনকারীরা, যারা ঘন ঘন ইউরোপে যাতায়াত করেছেন স্বল্পমেয়াদী ভিসায় এবং কোনো ধরনের ভিসাবিধি না ভেঙেই যাত্রা সম্পন্ন করে দেশে ফিরেছেন, তাদের ক্ষেত্রে চালু ছিল এই ছাড়। কড়াকড়ি পাস হলে, এই ছাড় তুলে নেওয়া হবে।
নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে কোন কাজে ইউরোপ যেতে স্বল্পমেয়াদী ভিসার আবেদন করছেন একজন বাংলাদেশি নাগরিক, অর্থাৎ সেটা পর্যটন, ব্যবসা, স্বল্পসময়ের পড়াশোনা, গবেষণা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য কিনা তা আর আলাদা কোনো গুরুত্ব বহন করবে না বলে জানিয়েছে কমিশন।
এইসব কড়াকড়ির আওতার বাইরে থাকবেন শুধু সেইসব বাংলাদেশি নাগরিক যাদের ইউরোপে চলাফেরা করার অধিকার ইতিমধ্যেই রয়েছে। অর্থাৎ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের পরিবারের সদস্য ও দীর্ঘমেয়াদী ভিসা বা রেসিডেন্স পারমিটপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এই কড়াকড়ির বাইরে থাকবেন।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ও ইউরোপিয়ান কমিশন
ইউরোপিয়ান কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশি দূতাবাসের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করে থাকে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলির অভিবাসন দপ্তর। বিশেষ করে, বৈধ কাগজহীন অভিবাসীদের চিহ্নিত করার কাজে এই দুই পক্ষ একসাথে কাজ করে থাকে বলে জানায় তারা। বাংলাদেশি দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করার পর জরুরি পাসপোর্ট বা ‘ইমারজেন্সি ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট’ দেবার দায়িত্ব বর্তায় তাদের ওপর।
পাশাপাশি, বাংলাদেশের নিজস্ব জাতীয় ডেটাবেস ঘেঁটে ও অভিবাসীদের সাথে কথা বলে বাংলাদেশি দূতাবাস নিশ্চিত করে এইসব অভিবাসীদের পরিচয়। এই কাজে কখনো কখনো ফ্রন্টেক্স বা ইউরোপের বাইরে থাকা কোনো সমন্বয়ক কর্মকর্তার সাহায্যেরও দরকার পরে বলে জানায় তারা।
এইসব কাগজহীন অভিবাসীদের চিহ্নিত করা ইউরোপের জন্য একটি চিন্তার বিষয়, জানান ইউরোপিয়ান কমিশনের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক মুখপাত্র। যদিও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বা বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় বারবার উঠে এসেছে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে ভুয়া নথি ব্যবহারের চলের কথা, ইউরোপিয়ান কমিশন বলে যে এবিষয়ে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
কোনো বৈধ কাগজহীন অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর আর্থিক দায় প্রাথমিকভাবে বর্তায় সেই রাষ্ট্রের ওপর, যেখানে বসবাস করছে সেই অভিবাসী। বিষয়টির সার্বিক তত্ত্বাবধান করে থাকে ইউরোপিয়ান রিটার্ন অ্যান্ড রি-ইন্টিগ্রেশন নেটওয়ার্ক। এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন নীচের লিংক:
https://returnnetwork.eu/
এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে বাংলাদেশিদেরও ফেরত পাঠানোর সুযোগ। ব্র্যাক ও আইআরএআইআরএ (ইরারা)-র সাথে মিলে এই কাজ সম্পন্ন করতে চেষ্টা করে ইইউ। ইরারা বিষয়ে বিস্তারিত জানুন এখানে।
শুধু তাই নয়, ২০১৮ সাল থেকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-কে একটি বিশেষ প্রকল্প গড়তে অর্থায়ন করছে ইউরোপিয়ান কমিশন, জানান মুখপাত্র। ইইউ-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এসওপি চুক্তির বাস্তবায়নে তাদের সাথে মিলে একটি ‘রিটার্নি কেইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ গড়ার কাজ করছে তারা। ২০২০ সালের নভেম্বরে এই ব্যবস্থা চালু হলেও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলে জানাচ্ছে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম।
ইউরোপিয়ান কমিশন গণমাধ্যমকে জানায় যে ২০১৯ সালে নয় হাজার ৫৭৫জন বাংলাদেশি নাগরিককে ইইউ ছাড়তে বলা হলে মোট ৮২০জন দেশে ফিরে যান। ২০২০ সালে নয় হাজার ৪০০ বাংলাদেশিকে দেশে ফরত পাঠানোর নির্দেশ দেবার পর দেশে যান ৫১৫জন। কমিশনের মতে, বাকিরা সবাই যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভেতরেই আছেন, তা হলফ করে বলা যাচ্ছেনা। কেউ কেউ হয়তো স্বেচ্ছায় অনিবন্ধিতভাবেই দেশে ফিরে গেছেন, বলে ধারণা তাদের।
তবে এই সংখ্যা কোনোমতেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বৈধ কাগজহীন বাংলাদেশিদের মোট সংখ্যার ধারেকাছে নেই, বলে জানায় তারা। এই সংখ্যা শুধু তাদেরই গোনে, যারা কোনোভাবে কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছেন ও চিহ্নিত হয়েছেন। এর বাইরেও থাকতে পারে একটি বড় সংখ্যক অনিবন্ধিত, কাগজহীন বাংলাদেশি।