এবার অভিনব কৌশলে মাঠে নেমেছে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট জালিয়াতি চক্র। প্রবাসী কর্মী ও বিদেশগামীদের টার্গেট করে চলছে তাদের রমরমা অসাধু কারবার। বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জাল ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট দিয়ে অনেক চলে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। আসল সার্টিফিকেটের মতো করে বানানো নকল সার্টিফিকেট যাচাই করতে বানানো হয়েছে সুরক্ষার নকল ওয়েবসাইট। গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, বিমানবন্দরে বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট যাচাইয়ের পাশাপাশি ভ্যাকসিন দেওয়ার সার্টিফিকেট যাচাই করেন বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসের কমীরা। ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করে দেখা হয় সার্টিফিকেটটি আসল কিনা। তবে বিমানবন্দরের কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিতে অভিনব কৌশলে প্রতারণা করছে একটি চক্র। সরকার প্রদত্ত আসল সার্টিফিকেটের মতো বানানো হচ্ছে সার্টিফিকেট। একইসঙ্গে সেই সার্টিফিকেটের মধ্যে থাকছে কিউআর কোড, সেটি স্ক্যান করলে চলে যাচ্ছে একটি ওয়েবসাইটে, যেটি এক ঝলক দেখলে যেকারও মনে হচ্ছে আসল। তবে ইউআরএল চেক করলেই দেখা যাবে, সুরক্ষার আদলে নকল ওয়েব সাইট। বিমানবন্দরে যাত্রীদের লম্বা লাইনের চাপ, একই রকম দেখতে হওয়ায় অনেকেই এমন ভুয়া সার্টিফিকেটে চলে গেছেন বিভিন্ন দেশে।
টিকা নয়, টাকা দিলেও পাওয়া যেত ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট। প্রবাসী কর্মী ও বিদেশগামীদের টার্গেট করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মীদের যোগসাজশে ছিল রমরমা অসাধু কারবার। তথ্য-প্রমাণসহ গণমাধ্যম গত অক্টোবরে এমন খবর প্রকাশ করলে মাঠে নামে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। ভ্যাকসিনের সার্টিফিকেট জালিয়াত চক্রের কমপক্ষে ২০ জন সদস্য আটকও হয়। তারপরও টিকার সার্টিফিকেট নিয়ে অবৈধ কারবার থেমে ছিলে না। তবে সরকারের নজরদারি বাড়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা সর্তক হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে প্রতারক চক্র। তারা হাতে নেয় নতুন নতুন কৌশল।
জানা গেছে, করোনার ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালানার জন্য সরকার তৈরি করে ‘সুরক্ষা’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম। ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফর্মের জন্য সুরক্ষা ডট গভ বিডি (https://surokkha.gov.bd/) নামে তৈরি করা হয় ওয়েবসাইট। একই সঙ্গে চালু করা হয় সুরক্ষা নামেই মোবাইল অ্যাপলিকেশন। একজন ব্যক্তির টিকার আবেদন থেকে শুরু করে টিকা সার্টিফিকেট প্রদান পর্যন্ত পুরো কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তির টিকা সার্টিফিকেটে দেওয়া হচ্ছে কিউ আর কোড। সেই কোড স্ক্যান করলে ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফর্মের ওয়েবসাইটে ভ্যারিফিকেশন করা যাবে। একইসঙ্গে নিবন্ধনের প্রদত্ত তথ্য দিয়েও সুরক্ষা ওয়েবসাইট থেকে সার্টিফিকেট ডাউনলোড করা যাবে।
গণমাধ্যমের হাতে একটি জাল সনদ এসেছে। সেই সনদটি দেখতে অবিকল আসল ভ্যাকসিন সনদের মতো। সেই সার্টিফিকেটে ফন্ট, কালার, সবকিছু আসল সনদের মতো। এমনকি সেই সনদের গায়ে সুরক্ষার আসল ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেওয়া। সেই সার্টিফিকেটটি স্ক্যান করতে চলে গেলো একটি ওয়েবসাইটে। সেটি হচ্ছে সুরক্ষা ডট অর্গ (https://surukkha.org)। জালিয়াত চক্র তাদের নিরাপত্তায় ওয়েব হোস্টি, ডোমেইন রেস্ট্রেশন সংক্রান্ত তথ্য লক করে রেখেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে এই ওয়েবের নেপথ্য চক্রের তথ্য জানা যাচ্ছে না।
তবে জালিয়াত চক্র নকল ওয়েবসাইট বানালেও আসল ওয়েবসাইটের সঙ্গে রিডাইরেক্ট করা হয়েছে। সরাসরি সুরুক্ষা ডট অর্গ (https://surukkha.org) লিংক দিয়ে ব্রাউজ করলে কোনও কিছুই পাওয়া যায় না। শুধু চক্রের সার্টিফিকেটের কিউআর কোড স্ক্যান করলে ভ্যারিফিকেশন পেজ আসে। এছাড়া সেই পেজের অন্যান্য ট্যাবে ক্লিক করলে আসল ওয়েবসাইট উন্মুক্ত হয়। ফলে খুব ভালো করে খেয়াল না করলে এই প্রতারণা হুট করে যে কেউ ধরতে পারবেন না।
শাহজালাল বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন, ‘বিমানবন্দরে যাত্রীদের করোনা পরীক্ষার সনদ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত বিষয় শতভাগ যাচাই করা হয়। প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে ৫/৬ যাত্রী ভুয়া সনদ নিয়ে আসেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
জানা গেছে, ট্রাভেল এজেন্সি, টিকেটিং এজেন্সিদের সহায়তায় এসব কাজে সক্রিয় প্রতারক চক্র। জাল সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। যাত্রী প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেনদেনটা হচ্ছে মোবাইল ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এখন ভ্যাকসিন ছাড়া প্রবেশ করা যায় না। আবার কোনও দেশে ভ্যাকসিন ছাড়া গেলে লাখ টাকা খরচ করে হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। আবার দেশভেদে অনুমোদিত ভ্যাকসিনও ভিন্ন। এতে বিদেশগামী প্রবাসীদের কাজে ফিরতে হলে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটের বিকল্প নেই। এ কারণে অনেক প্রবাসী এসব প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন নিজের বিদেশ যাত্রা নিশ্চিত করতে।