নৌযান আবিষ্কার : আধুনিক সভ্যতার বিস্তারে জাহাজের অবদান অনস্বীকার্য। এখন পর্যন্ত জাহাজ তথা নৌপরিবহনই সবচেয়ে সস্তা পরিবহন হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ হয় সমুদ্রপথে নৌযানের মাধ্যমেই। বিশ্বকে পাল্টে দেওয়া এই নৌযান কে আবিষ্কার করেছিলেন তা নিশ্চিত করে বলা দুষ্কর। গবেষকদের মতে খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার থেকে শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ বছর পর্যন্ত নৌযানের উন্নয়ন সাধন হয়। তবে এর প্রধান আবিষ্কারক নিয়ে তেমন কোনো পাকাপোক্ত প্রমাণ চোখে পড়ে না।
তবে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত থেকে ধারণা করা হয় যে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নৌযান আবিষ্কৃত হয় ওহির মাধ্যমে, যা এসেছিল হজরত নুহ (আ.)-এর কাছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আপনি আমাদের চাক্ষুষ তত্ত্বাবধানে ও আমাদের ওহি অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ করুন।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩৭)
এ আয়াত থেকে অনেক তাফসিরবিদ এটা বুঝেছেন যে, নুহ (সা.)-ই সর্বপ্রথম নৌযান তৈরি করেছিলেন। (আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর) কেননা উল্লিখিত আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আপনি নৌকা তৈরি করুন আমার চাক্ষুষ তত্ত্বাবধানে ও ওহি অনুসারে।’ এতে বোঝা গেল যে, নৌকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি ও নির্মাণকৌশল আল্লাহ তাঁকে ওহির মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছিলেন।
লোহা দিয়ে অত্যাধুনিক জিনিস তৈরি : সভ্যতার বিকাশে লোহার অবদান অপরিসীম। পৃথিবীর যে দেশ যত বেশি লোহা ও ইস্পাতের ব্যবহার করে, তারাই তত বেশি সভ্যতার সোপানে পৌঁছে। নদ-নদী-পাহাড় শাসন করা, তাইফুন-সাইক্লোন-ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া, তরবারি-বন্দুক-কামান বানিয়ে পরাশক্তি গড়ে ওঠা, জাহাজ নির্মাণ করে দেশ-বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য স্থাপন ও কলোনি গড়ে তোলা, কলকারখানা গড়ে শিল্প বিপ্লব ঘটানো—এসবই লোহাকেন্দ্রিক এক সভ্যতার নাম। বর্তমান যুগেও পৃথিবীজুড়ে লোহার ব্যবহার এতই ব্যাপক যে জাপানিদের কাছে লোহা হচ্ছে ফেব্রিক অব ডেইলি লাইফ।
এই লোহাকে মহান আল্লাহ হজরত দাউদ (আ.)-এর হাতে এতটাই নরম করে দিয়েছিলেন যে তিনি তা দিয়ে অত্যাধুনিক বর্ম বানাতে পারতেন।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর অবশ্যই আমরা আমাদের পক্ষ থেকে দাউদকে দিয়েছিলাম মর্যাদা এবং আদেশ করেছিলাম, হে পর্বতমালা! তোমরা দাউদের সঙ্গে বারবার আমার পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং পাখিদেরও। আর তার জন্য আমি নরম করে দিয়েছিলাম লোহা। (এ নির্দেশ দিয়ে যে) আপনি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করুন এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করুন। আর তোমরা সৎ কাজ করো, নিশ্চয় তোমরা যা কিছু করো আমি তার সম্যক দ্রষ্টা। (সুরা : সাবা, আয়াত : ১০-১১)
মানবজাতি যখন থেকে লোহাকে গলিয়ে অত্যাধুনিক জিনিসপত্র বানানোর ধারণা পেয়েছে, তখন থেকে তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
অত্যাধুনিক নির্মাণশিল্প : নির্মাণশিল্পে বিশ্ববিখ্যাত ছিল হুদ (আ.)-এর অনুসারী আদ জাতি। তারা পাহাড় কেটে সুউচ্চ প্রাসাদ ও টাওয়ার তৈরি করে ফেলত। কিন্তু মহান আল্লাহর হুকুম অমান্য করায় তাদের ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি দেখোনি, তোমার প্রতিপালক আদ জাতির ইরাম গোত্রের প্রতি কী (আচরণ) করেছেন, যারা ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের অধিকারী, যার সমতুল্য (প্রাসাদ) কোনো দেশে নির্মিত হয়নি।’ (সুরা : ফাজর, আয়াত : ৬-৮)
সমুদ্রের তলদেশে টানেল : বর্তমানে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে টানেল করে খুব অল্প সময়েই এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াত করা হয়। যার উজ্জ্বল উদাহরণ চ্যানেল টানেল। সাধারণত যুক্তরাজ্যের ফোকস্টোন থেকে ফ্রান্সের ক্লেঁ শহরে যেতে সময় লাগে ৩৫ মিনিট। কিন্তু সমুদ্রের তলদেশে স্থাপিত এই টানেল দিয়ে মাত্র এক মিনিট বা তার বেশি সময়েই সেখানে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।
মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধু মুসা (আ.)-এর জন্যও সাগরের বুক চিরে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফেরাউনের বাহিনী থেকে তাঁদের পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। তখনই পৃথিবীবাসী প্রথম এই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর আমি মুসার প্রতি ওহি পাঠালাম যে আপনার লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করুন। ফলে তা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মতো হয়ে গেল। (সুরা : শুআরা, আয়াত : ৩৩)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্মরণ করো, যখন আমি তোমাদের জন্য সাগরকে বিভক্ত করেছিলাম এবং তোমাদের উদ্ধার করেছিলাম।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৫০)
আকাশপথে সফর : বর্তমানে আকাশপথে আমরা এক দেশ অন্য দেশে খুব সহজেই চলে যেতে পারি। কিন্তু এই কাজটি একসময় স্বাভাবিক ছিল না। এখন আমরা অনেক বড় বড় লাক্সারি বিমান দেখতে পাই, কিন্তু কয়েক বছর আগেও এতটা অত্যাধুনিক বিমান ছিল না। কিন্তু হাজার হাজার বছর আগে মহান আল্লাহর এক নবী ছিলেন, যিনি তাঁর সিংহাসনসহ আকাশে উড়ে বেড়াতে পারতেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং আমি সুলাইমানের অধীন করে দিয়েছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ ও বিকেলে এক মাসের পথ অতিক্রম করত।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১২)
লিফটের ধারণা : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে, যেমন—মাকামে ইবরাহিমে।’
‘মাকাম’ আরবি শব্দ, যার অর্থ দাঁড়ানোর জায়গা। মাকামে ইবরাহিম দ্বারা মূলত একটি বিশেষ পাথরখণ্ডকে নির্দেশ করা হয়, যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) কাবা নির্মাণ করেছিলেন।
কোনো কোনো তাফসিরবিদ ও ইতিহাসবিদদের মতে, কাবাঘর নির্মাণের সময় হজরত ইবরাহিম (আ.) এমন একটি বিশেষ পাথরখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে কাবার নির্মাণ সম্পন্ন করেন, যে পাথর ইবরাহিম (আ.)-কে নিয়ে তার ইচ্ছামতো স্থানে চলাচল করতে পারত এবং ইবরাহিম (আ.)-এর প্রয়োজনে তা উঁচু হতে পারত। কাবার নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর এই পাথরটিকে কাবার নিকটে সংরক্ষিত করে রাখা হয়।
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা