২০১৫ ও ২০১৬ সালে যশোর ও জয়পুরহাটের ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৪ নেতাকে গুম করার পর গভীর রাতে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার অভিযোগে র্যাব-ডিবি ও পুলিশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (০৫ নভেম্বর) দুপুরে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এসে ওই নেতারা অভিযোগ দায়ের করেন।
এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সহকারী আইন সম্পাদক আমানুল্লাহ আদিব।
ওই চার নেতা হলেন—২০১৫ সালের জয়পুরহাট জেলার ছাত্রশিবিরের সভাপতি মো. আবুজর গিফারী ও জেলা সেক্রেটারি ওমর আলী। বাকি দুইজন হলেন—যশোর জেলা পশ্চিম চৌগাছা উপজেলার ২০১৬ সালের সাহিত্য সম্পাদক মো. রুহুল আমিন ও থানা সেক্রেটারি ইস্রাফিল হোসেন।
অভিযোগ দায়ের করার বিষয়ে ছাত্রশিবিরের আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের বর্বর নির্যাতনের কারণে তাদের পা কেটে ফেলা হয়েছে এবং কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে। রাত ৩টার দিকে আবুজর গিফারী ও ওমর আলীর পায়ে গুলি করে তাদের পা ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। একইভাবে রুহুল আমিন ও ইস্রাফিল হোসেনকে গভীর রাতে নির্জন স্থানে নিয়ে হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো হয় এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় তাদের দুজনের দুই পায়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, জয়পুরহাটের ১২ জন এবং চৌগাছা থানার ৯ জন র্যাব ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
অভিযোগে বলা হয়, আবুজর গিফারী ও ওমর আলী ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর জয়পুরহাট থেকে হানিফ বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। আব্দুল্লাহপুর পৌঁছালে ৯ ডিসেম্বর সকাল ৬টার দিকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে দুজনকেই মাইক্রোবাসে উঠিয়ে উত্তরা র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৫ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে তাদের মাইক্রোবাসে করে হাত এবং চোখ বেঁধে রাজশাহী র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৫ ডিসেম্বর রাত এবং ১৬ ডিসেম্বর সারাদিন আবারো চালানো হয় নির্যাতন। ১৬ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে রাজশাহী থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচবিবি থানার শিমলতলী এলাকায়। এরপর সেখান থেকে তাদের সঙ্গে বোমা ও অস্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তাদের রাত ৪টার দিকে জয়পুরহাট র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় আবারো শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন। এরপর সকাল ১০টার দিকে অস্ত্র এবং বোমাসহ সংবাদ সম্মেলন করে জয়পুরহাট র্যাবের তৎকালীন মিডিয়া উয়িং। দুপুরে পাঁচবিবি থানায় তাদের অস্ত্র মামলা দিয়ে হস্তান্তর করা হয়।
সেখানেও রাত ২টা পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশ নির্যাতন চালায়। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে তাদের হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় আওলায় ইউনিয়নের একটি পরিত্যক্ত জায়গায়। পুলিশ দুজনের হাঁটুতে গুলি করে পা ঝাঁঝরা করে দেয়। তাদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করে দেন। সেখানেও তাদের চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাটানো হয়। সেখানে অপারেশন করে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। দুজনেরই প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় মাংস ৭৫ শতাংশ পঁচে যাওয়ায় ২৭ ডিসেম্বর দুজনের অনুমতি সাপেক্ষে ২টি পা কেটে ফেলা হয়। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলে ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জয়পুরহাট কারাগারে পাঠানো হয়।
মো. রুহুল আমিন এবং ইস্রাফিল হোসেনের অভিযোগে বলা হয়, ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট সাংগঠনিক কাজ শেষ করে রুহুল আমিন বাড়ি যাওয়ার পথে বন্দুলিতলা শফি মল্লিকের ইটভাটার মোড় থেকে চৌগাছা থানার একজন এসআই এবং দুজন এএসআই তাদের গ্রেপ্তার করে চৌগাছা থানায় নিয়ে যান। ৪ আগস্ট তাদের ডিবি কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের আবার চৌগাছা থানায় নিয়ে আসার পথে কয়ারপাড়া এলাকায় এলে দুজনকেই হ্যান্ডকাপ পরানো হয় এবং চোখ বেঁধে ফেলা হয়। গভীর রাতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বন্দুলিতলার নির্জন মাঠে। সেখানে নিয়ে দুজনের হাঁটুতে পুলিশ গুলি করে পা ঝাঁঝরা করে দেয়। সেখান থেকে তাদের উপজেলা সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই তাদের রেফার করা হয় যশোর সদর হাসপাতালে। সেখানে দুই দিন চিকিৎসার পর কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাদের ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভর্তি হওয়ার ৭ দিন পর পায়ে পচন ধরলে ডাক্তার পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত দেন এবং পা কেটে ফেলা হয়। এরমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করা হয়, বন্দুক যুদ্ধে ২ শিবির নেতা আহত। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দিয়ে ২ মাস চিকিৎসার পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে।