গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বাসায় বাসায় গিয়ে জেরা করা, থানায় ডেকে পাঠানো এবং ক্ষেত্রবিশেষে সাদা কাগজে সই নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে আজ বৃহস্পতিবার গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের মঞ্চ ‘মায়ের ডাক’ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র পৃথক বিবৃতি দিয়েছে।
ভুক্তভোগী এমন পাঁচটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। এসব পরিবারের একটি বাসাবোর আহাম্মদনগরে থাকে। এ পরিবারের ছেলে সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ।
মাহবুবের ছোট ভাই শাকিল খান গণমাধ্যমকে বলেন, ১০ জানুয়ারি সবুজবাগ থানা থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি সব কাগজপত্রসহ থানায় যাওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা ফের তাঁর সঙ্গে বাসায় আসেন। তাঁদের বাবা আবদুল জলিল খান ছেলে গুম হওয়ার পর সাধারণ ডায়েরি করায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা জরুরি বলে জানায় পুলিশ।
বাসায় গিয়ে পুলিশ সদস্যরা একটি বিবৃতিতে তাঁদের ৭৫ বছর বয়সী বাবার কাছ থেকে জোর করে সই নেওয়ার চেষ্টা করেন। আবদুল জলিল সই দিতে অস্বীকৃতি জানালে সাত–আটজন পুলিশ সদস্য তাঁকে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে বলে হুমকি দেন। তিনি বারবার বলতে থাকেন, পুলিশের দেওয়া কাগজে সই করবেন না, নিজে লিখে পুলিশকে দেবেন। অবশেষে রাত ১১টার কিছু পরে পুলিশ তাঁদের বাসা থেকে চলে যায়।
সবুজবাগ থানার ওসি মুরাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অভিযোগ সত্য নয়। এমনিই আমরা মাহবুব হোসেনের ভাইকে ডেকেছিলাম। অনেক দিন ধরে নিখোঁজ, আমরা তো খোঁজখবর নিতেই পারি।’
তবে কেউ কেউ ভয়ে সই করে ফেলেছেন বলে জানা গেছে। এর বাইরে কারও কারও বাসায় পুলিশ বারবার যাচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। তাঁদের একজন বেবি আক্তার। প্রায় ১০ বছর আগে পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ থেকে পুলিশ পরিচয়ে একদল ব্যক্তি ছাত্রদল নেতা তরিকুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যায়। গতকাল বুধবার রাতে তাঁর স্ত্রী বেবি আক্তারকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়।
বেবি আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ওরা শুধু আমাদের কাছে এসে তরিকুলের খোঁজ করে। আমি বলি, খবর তো আপনাদের কাছে, আমাদের কাছে কী খোঁজেন?’ বেবি আরও জানান, গতকাল রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত পল্লবী থানায় তাঁদের বসিয়ে রাখা হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ এসে তাঁদের কাছ থেকে তরিকুল গুম হওয়ার পর থানায় করা সাধারণ ডায়েরি, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপি নিয়ে গেছে।
বিএনপির তৎকালীন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমানে ২৫ নম্বর) সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলামের বোন সানজিদা ইসলাম বলেন, তাঁদের বাড়িতেও পুলিশ কয়েকবার এসেছে। তারা খুব মোলায়েমভাবে তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে এবং ভাইয়ের বিরুদ্ধে কী কী মামলা ছিল সে খবর জানিয়ে গেছে।
ঢাকার বাইরেও গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের বাড়িতে পুলিশের দৌড়ঝাঁপের খবর পাওয়া গেছে। নোয়াখালী থেকে গুম হওয়া আলমগীর হোসেনের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁকে থানায় ডেকে পুলিশ কথা বলেছে।
আজ বৃহস্পতিবার গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের মঞ্চ ‘মায়ের ডাক’ এক বিবৃতিতে পুলিশি তৎপরতায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে।
মায়ের ডাক–এর সংগঠক আফরোজা ইসলামের সই করা ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের নির্দেশে পুলিশ বারবার গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে বারবার গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছে এবং রাতে তাঁদের থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গুমের শিকার ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন এবং পরিবার তথ্য গোপন করেছে—এমন বাক্য লেখা কাগজে সই দেওয়ার জন্য পুলিশ স্বজনদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে।
ওই বিবৃতিতে ‘মায়ের ডাক’–এর সদস্যরা আরও জানান, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা নানাধরনের সমস্যা ও মানসিক চাপ নিয়ে জীবনযাপন করছেন। যাঁরা গুম হয়েছেন, তাঁরা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ফলে এসব পরিবার অর্থকষ্টে আছে।
এর মধ্যে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চাপ দিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে সই নেওয়ার চেষ্টাসহ বিভিন্ন তৎপরতায় পরিবারগুলো আতঙ্কিত। তাঁরা আরও বলেন, গুমের ঘটনায় সরকারি বাহিনী জড়িত, এমন তথ্যপ্রমাণ তাঁদের হাতে আছে। তাঁরা হয়রানি বন্ধ করে স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
পৃথক বিবৃতিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন আচরণ সম্পূর্ণ বেআইনি। দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকা এসব ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা ও জড়িতদের চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা জোরদার করার পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের তৎপরতা অগ্রহণযোগ্য।
গুমের শিকার এসব ব্যক্তির পরিবার দীর্ঘ সময় ধরে স্বজনদের ফেরার প্রতীক্ষায় রয়েছে। প্রতিমুহূর্তে এসব পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। এভাবে তাঁদের হয়রানি করায় তাঁরা আরও বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের তৎপরতা প্রকৃতপক্ষে গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে জেরা বা সাদা কাগজে সই নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটার কথা নয়। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের বাসায় বাসায় পুলিশের যাওয়া সম্পর্কে তিনি অবহিত নন।
গত বছরের জুনে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ গুম হওয়া ৩৪ জনের ব্যাপারে জানতে চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এর ৬ মাসের মাথায় গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ক্রসফায়ার ও গুমের অভিযোগ তুলে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মার্কিন রাজস্ব দপ্তর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই সময় জানায়, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬ শতাধিক ব্যক্তির অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ও নির্যাতনের জন্য দায়ী।