দেশের ৭৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ পানি পান করছে বলে জানিয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন। সোমবার (২২ মার্চ) আন্তর্জাতিক নিরাপদ পানি দিবস উপলক্ষে ‘বিশুদ্ধ পানির সংস্থান–আনবে নিরাপদ জীবন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ তথ্য জানানো হয়। রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ও নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। উদ্বোধন করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রফেসর ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন, প্রত্যাশার বাংলাদেশ’র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন, মাতৃভূমি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এম মাইন উদ্দিন মিয়া, সবুজ আন্দোলন পরিচালনা পরিষদের মহাসচিব মহসিন সিকদার পাভেল, বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহেদ শফিক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদ ইসলাম, নাট্যব্যক্তিত্ব আবীর বাঙ্গালী।
সভাপ্রধান ছিলেন সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের পরিচালক ও সাধারণ সম্পাদক অভিনেতা উদয় খান এবং সঞ্চালনা করেন সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল ইসলাম চৌধুরী (অর্ণব)। এ ছাড়াও ছিলেন সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ-দফতর সম্পাদক আব্দুল আজিজ, নিরাপত্তা বিষয়ক সম্পাদক এমএ মামুন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ-সভাপতি কনক চন্দ্র বর্মন, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন পলাশ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিয়া আক্তার, আইয়ুব আনসারী প্রমুখ।
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে সবুজ আন্দোলন পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, ‘প্রতিবছর এই দিনে সারা পৃথিবীতে নিরাপদ পানি দিবস পালন করা হয়। সর্বপ্রথম ব্রাজিলে ১৯৯০ সালে ২২ মার্চ নিরাপদ পানি দিবস পালন করা হয়েছিল। তবে ১৯৯৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরাপদ পানি দিবস পালন করা হচ্ছে। এশিয়া অঞ্চলে সব থেকে নিরাপদ পানি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি কমে গেছে এবং লবণাক্ত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের তথ্য ও গবেষণা পরিষদ বিগত আট মাস সিটি করপোরেশন এলাকা এবং দেশের ২১টি জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা ও সুপেয় পানি ব্যবহারের মাত্রা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে। দেখা গেছে শহরের অধিকাংশ এলাকায় বিশেষ করে সিটি করপোরেশনে বসবাসরত শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ অনিরাপদ পানি পান করছেন। ঢাকা সিটির ওয়াসার পানিতে আয়রন, ক্যাডমিয়াম, মিনি প্লাস্টিক, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা দেখা গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে যা প্রচার করা হয়েছে। আমাদের মতে উপকূলীয় অঞ্চলের শতকরা ৭৭ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ পানি পান করার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীরা কম পানি পান করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, নারীদের ক্ষেত্রে জরায়ু ক্যানসার এবং বন্ধ্যাত্ব রোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’
বাপ্পি সরদার আরও বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলের শতকরা ৮০ শতাংশ জনগণ পুকুরের পানির ওপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্রের পানি ফসলি জমি, পুকুর ও নদীতে ঢুকে পড়ায় লবণাক্ত পানির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ শতাংশ লবণাক্ত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে ২০৫০ সালে সারাদেশে খাবার পানি ও সেচের পানির জন্য মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ সংকটে পড়বে। জরিপে দেখা যায়, সারাদেশে বর্তমানে সুপেয় পানি সংকটে ভুগছে প্রায় ৭৩ শতাংশ জনগণ। সিটি করপোরেশন এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য প্রতি লিটারে চার টাকা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে এক টাকার অধিক গুণতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ খনন করতে এক হাজার থেকে দুই হাজার মিটার গভীরে যেতে হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজের জন্য পানি সংকট চরম আকার ধারণ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র কার্বন নিঃসরণ ও মিথেন গ্যাসের ব্যবহার বাড়িয়েছে। যার ফলে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের তলদেশে উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ারের সময় পানির তীব্রতা, উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক দূষণ, জলাবদ্ধতা, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জল ও মাটি দূষণ এবং নদী ভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি পানি দূষণজনিত জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে চর্ম রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে ২১ জেলায় স্বাদুপানির এলাকা ৫০ ভাগ থেকে কমে ৩৪ ভাগ হয়েছে। মৃদু লবণাক্ত এলাকা ৫২ ভাগ থেকে কমে ৪৬ ভাগ হয়েছে। আগামীতে প্রচণ্ড লবণাক্ত এলাকা চার ভাগ থেকে বেড়ে ২০ ভাগে রূপান্তরিত হবে। বর্তমানে ৩০ বছরে ১০ ভাগ এলাকা এবং ১০ ভাগ তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
সভায় নিরাপদ পানি ব্যবস্থা জোরদার করতে ১০টি দাবি তুলে ধরা হয়।