কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার নিয়ন্ত্রণ ‘অসাংবিধানিক’ বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিদেশ যাওয়ার ওপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দেওয়া নিষেধাজ্ঞা চ্যালেঞ্জ করে নরসিংদীর আতাউর রহমানের করা রিটের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ অভিমত প্রকাশ করেন উচ্চআদালত।
রোববার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ১২ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করেছেন।
রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, নাগরিকের চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করা (বিরত রাখা) অসাংবিধানিক। এটা বাস্তবতা যে, দুর্নীতি কিংবা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলাগুলো অনুসন্ধান বা তদন্ত কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, যদিওবা সংশ্লিষ্ট বিধিতে অনুসন্ধান বা তদন্তের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আমাদের বিচারিক অভিজ্ঞতা বলে যে, কমিশন কিংবা অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্যক্রম আইন বা বিধিতে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারে না।’
‘এটাও বাস্তবতা যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত অনেকে বিভিন্ন অজুহাতে দেশত্যাগ করছে এবং পরে তাদের আর আইন-আদালতের সম্মুখীন করা সম্ভব হচ্ছে না।
এসব বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে দুর্নীতি বা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলায় কিংবা অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বারিত বা তাঁর চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, যা সময়ের চাহিদাও বটে। সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধির অনুপস্থিতিতে কোনো তদন্ত সংস্থার দাপ্তরিক আদেশ দিয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ বা কার্যধারা গ্রহণ সংবিধান পরিপন্থি।’
রায়ে আদালত আরও বলেন, ‘আমাদের সুস্পষ্ট অভিমত এই যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বারিত করার প্রয়োজন হলে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধি প্রণয়ন এখন সময়ের বাস্তবতা। এবং ওই আইন বা বিধিতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশত্যাগে বারিত করার কারণ জানানো, গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির বক্তব্য/আপত্তি প্রদানের সুযোগ রাখতে হবে। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারো ওপর এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ সংবিধান ও মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ, তাই এর সময়সীমা নির্দিষ্ট করাও ন্যায়সঙ্গত হবে।’
রায়ে আদালত আরও বলেন, ‘অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে যেকোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বারিত করার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রণয়ন করা। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের আইন বা বিধি প্রণয়ন করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতের কাছে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রার্থনা করা এবং আদালতের অনুমতি গ্রহণ করা।’
দুর্নীতি মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তির বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে দুদক নয়, সিদ্ধান্ত নেবেন বিশেষ জজ আদালত- গত ১৬ মার্চ এমন আদেশ দেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওইদিন এ আদেশ দেন।
নরসিংদীর আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউর রহমানের করা এক আবেদনের ওপর শুনানির সময় এ আদেশ দেন আদালত। আদালতে আতাউর রহমানের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মুন্সী মনিরুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এ কে এম ফজলুল হক।
মামলার বিবরণে জানা যায়, দুদক ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট আতাউর রহমানের সম্পদের তথ্য চেয়ে নোটিশ দেয়। নোটিশের পর ২২ অক্টোবর তিনি তার সম্পদের তথ্য দুদকে দাখিল করেন।
দুদক সম্পদের তথ্য পেয়ে অনুসন্ধানে নামে। এই অনুসন্ধানের সময় গতবছর ২০ ডিসেম্বর আতাউর রহমানের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি দেয় দুদক। এ অবস্থায় এই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন আতাউর রহমান। এ আবেদনের ওপর হাইকোর্ট গত ৪ ফেব্রুয়ারি রুল জারি করেন।