দেশের যুবসমাজকে বিপৎগামীতা থেকে রক্ষা করতে ২০১৭ সালে সরকার পর্নবিরোধী কর্মসূচি শুরু করে। এই কর্মসূচির আওতায় দেশে এখন পর্যন্ত ২০ হাজারেরও বেশি পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই পদক্ষেপের ফলে পর্নোগ্রাফি দেখা ও প্রচার কতটা কমানো গেছে, তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক, লাইকিসহ অন্যান্য সহজ মাধ্যমগুলোতে আনসেন্সরড অসংখ্য পর্নোগ্রাফি সংশ্লিষ্ট কনটেন্ট এখন একই প্রভাব রাখছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
এই বিতর্কের সূত্র ধরে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিনেট’র যৌথ গবেষণার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
“ইমপ্যাক্ট অভ ইজি অ্যাকসেসিবিলিটি অব পর্নোগ্রাফি অন দি ইন্টারনেট অ্যান্ড ইটস রেলেভ্যান্স উইথ ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন অ্যান্ড গার্লজ ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মাধ্যমে একটি বড় অংশের মধ্যে অশ্লীল কনটেন্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে।
সংবেদনশীল জরিপ হওয়ায় অংশগ্রহণকারীদের সাক্ষাৎকারের সঙ্গে ডেস্ক গবেষণা, প্রকাশিত গবেষণাপত্র, সংবাদপত্রের নিবন্ধ প্রভৃতি যুক্ত করা হয়েছে।
কনটেন্টগুলো যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে অনেক সময় কিছু ভিডিও সামনে চলে আসে। নারী ও পুরুষদের সমন্বয়ে করা ওইসব ভিডিও শুরু হয় ব্যক্তিগত গল্প দিয়ে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এগুলো যৌন উত্তেজনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
এই ভিডিওগুলোকে “পর্নোগ্রাফি” বলা কঠিন। এই কনটেন্টগুলোতে সরাসরি নগ্নতা থাকে না। তবে এই ভিডিওগুলোতে নারীদের পর্নোগ্রাফির বস্তু হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়। ফলে দর্শকের ওপর এগুলো পর্নোগ্রাফির মতোই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে বলে প্রতিবেদনে মতামত দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিনেট’র রিসার্চ অ্যান্ড মোবিলাইজেশন ম্যানেজার শেখ শুচিতা জাহান স্নেহা বলেন, “আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলোকে পর্নোগ্রাফি বিবেচনায় আপলোড করা হয় না। এসবের কনটেন্ট হিসেবে হয়তো কোনো নারী বা কোনো ছোট ভিডিও থাকে। কিন্তু সেগুলোকেই এখন পর্নোগ্রাফি হিসেবে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।”
তিনি জানান, এই কনটেন্টগুলো শিক্ষার্থীরা দেখেছেন এবং তারা এগুলো নিয়ে চর্চাও করেন। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্নোগ্রাফি প্রচারের কেবল মাধ্যম বদলেছে।
এসব যৌন উত্তেজক কনটেন্ট ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী
এ রকম শত শত ভিডিও ফেসবুক, টিকটক ও লাইকির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি স্ট্রিম করা হয়। এছাড়া এসব ভিডিও, ছবি সহজেই দেখা যায়। যেকোনো বয়সের যেকেউ এই ভিডিও ও ছবিগুলো দেখতে এবং শেয়ার করতে পারেন।
এর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওই গবেষণার প্রধান এবিএম সিরাজুল হোসেন জানান, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট পেয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে এমন অসংখ্য কামোত্তেজক গল্পের কনটেন্ট রয়েছে যা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে, লাখ লাখ ভিউ পেয়েছে।
তিনি বলেন, “এসব যৌন কনটেন্ট বানানো হয়েছে দেশেই। আর তা বানানো হয়েছে স্থানীয় দর্শকদের জন্য। অন্যান্য যৌন কনটেন্টের মধ্যে আছে পতিতালয়ে লাইভ করা কিংবা গোপনে নারীদের ভিডিও ধারণ করা। বা প্রবাসীর সঙ্গে এদেশের কোনো নারীর একান্ত ব্যক্তিগত ভিডিও কলের রেকর্ড।”
পর্নোগ্রাফি নাকি সাইবার সেক্স
পর্ন ওয়েবসাইটগুলো নিষিদ্ধ করলেও কোনো-না-কোনো মাধ্যমে এগুলোতে ঢোকা যায়। ওই গবেষণা দলটি এ রকম প্রচুর ব্লগ সাইট পেয়েছে। যে সাইটগুলোতে ডার্ক কনটেন্টও প্রচুর।
গবেষণার প্রধান সিরাজুল হোসেন বলেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যেসব জিনিস খুঁজে পেয়েছি সেগুলো আসলে পর্নোগ্রাফিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।”
দেশের প্রেক্ষাপটে তিনি এগুলোকে পর্নোগ্রাফি নয়, ‘সাইবারসেক্স’ হিসেবে মনে করেন।
সাইবার সেক্স রোধে করণীয়
ইতিবাচক পরিবর্তন করতে হলে প্রথমত অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। গবেষণা দলটি জানিয়েছে, তারা এসব তথ্য পাওয়ার পর অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু অভিভাবকেরা এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সিনিয়র সমন্বয়ক শাহানা হুদা রঞ্জনা জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব “পর্নোগ্রাফিতে” নারীদের যেভাবে হেয় করা হচ্ছে, বাস্তব জীবনেও তার চর্চা হচ্ছে। অনেকসময় নারীরা স্বেচ্ছায় এসব যৌনতাপূর্ণ কনটেন্ট তৈরিতে অংশ নেন। ফলে বিষয়টি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “এসব পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট কেবল বিনোদন বা যৌন উত্তেজনার জন্যই তৈরি করা হচ্ছে না, বরং নারীদের অবমাননার মাধ্যম হিসেবেও তৈরি করা হচ্ছে।”
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক মারজিয়া আল-হাকিম বলেন, “নারীদের নিয়ে হাস্যরসের নামে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন (অবজেক্টিফাই) করার সময় আমরা শুনি- এতে দোষের কী আছে? এটা তো একটু মজা করা ছাড়া আর কিছু না।”
তিনি আরও বলেন, “প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা এমন একটি বিশ্বাস-ব্যবস্থা তৈরি করেছি যেখানে নারীদের পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটি সহজে দূর হবে না। এই সমস্যাটি মোকাবেলা করার জন্য বিস্তর প্রচেষ্টার দরকার। নারীদের এখনও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। তাই এসব কাজকর্ম নিয়ে আমরা খুব কম সময়ই প্রশ্ন তুলতে দেখি।”