ইসলাম প্রচারের কাজে এদেশে বহু আরব, ইরানি, আফগান ও তুর্কি মুসলমান এবং সুফি দরবেশের আবির্ভাব ঘটে। দায়িরা দ্বীনের দাওয়াতের স্বার্থে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। সীমান্তবর্তী শেরপুরে এমনি একজন প্রজ্ঞাপুরুষ ফসিহ্ উদ্দিন (রহ:)। যিনি এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
জানাযায়, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে জেলার সদর উপজেলার যোগিনীমুড়া গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব মৌলভী দ্বীন মুহাম্মদ ও পিতামহ আলহাজ সুফি মজনু ফরায়েজী।
শিক্ষা জীবন ও আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভ: পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী পিতার নিকট হতে আরবি, ফার্সি ও ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করেন। খোশ মুহাম্মদ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত কামারের চর মাদ্রাসায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু। এরপর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের প্রতিষ্ঠিত হুগলী আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পরে তিনি অধিকতর শিক্ষা লাভের জন্য ভারতের কানপুরে গমন করেন এবং কানপুর মাদ্রাসা হতে দাওরায়ে হাদিস সম্পূন্ন করেন।
প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী, আধ্যাত্মিক দীক্ষা বা ইলমে মারিফতের দিকে মনোনিবেশ করেন। এ সময় আসাম, দিল্লি, মাদ্রাজ, ভ’পাল ও এলাহাবাদসহ ভারত বর্ষের উল্লেখ্যযোগ্য স্থানে ভ্রমণ করে বরেন্য উলামা-ই-কেরামের সংস্পর্শে আসেন এবং ভারতের প্রখ্যাত আলেম ও সূফী সাধক এলাহাবাদের পীর সাহেবের বায়’আত গ্রহন করেন। অল্পদিনেই ইলমে মারিফতের প্রভ’ত উন্নতি সাধন করেন। স্বীয় পীর এতে খুশি হয়ে বাংলা হতে এলাহাবাদে যোগাযোগের ‘অসুবিধা’ বিবেচনা করে বাংলার মুজাদ্দিদ হযরত মাওলানা শাহ সূফী আবু বক্কর সিদ্দীক (ফুরফুরা শরিফের পীর) এর নিকট বায়’আত গ্রহনের পরামর্শ দেন। পরামর্শ গ্রহণ করে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ফুরফুরা শরিফের পীর সাহেবের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়। পরে ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে পাশ্ববর্তী জামালপুরের ইসলামপুর থানার ডিপারচরে এক ঐতিহাসিক ধর্মসভায় লক্ষ লক্ষ শ্রোতার সামনে তাঁকে খেলাফত দান করেন। এসময় ফুরফুরার উল্লেখযোগ্য খলিফা মাওলানা নিসার উদ্দিন (রহ:), মাওলানা রহুল আমিন (রহ:) ও মাওলানা আব্দুল খালেক (রহ:) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
হজ্বব্রত পালন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা: মাওানা ফসিহ্ উদ্দিন (রহ:) জীবনে ৩ বার হজ্বব্রত পালন করেন। পিতা আলহাজ দ্বীন মুহাম্মদের সাথে ২ বার হজ্বব্রত পালন করেন। সর্বশেষ ১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হজ¦ব্রত পালন করেন। মাওলানা বিশেষ প্রয়োজনে একবার চট্টগ্রামে গমণ করেন। সেখানে বরিশালের একজন আলেমের সাথে পরিচয় হয়। তিনি মাওলানাকে নিয়ে বরিশালে গমন করেন। সেখানে গিয়ে মাওলানা একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং কিছুদিন সেখানে শিক্ষকতা করার পর মাওলানা শেরপুরের নিজ গ্রামে ফিওে আসেন। স্থানীয় মুসলমানদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে যোগিনীমুড়া গ্রামে একটি নিউস্কিম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এতে তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। মাওলানা অত্যান্ত সাহসিকতার সাথে যাবতীয় বাঁধা বিপত্তি মোকাবিলা করে মাদ্রাসাটি সুন্দরভাবে পরিচালনা করেন। পাক আমলের শেষের দিকে মাদ্রাসটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
সমাজসেবা: সকল প্রকার কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে মাওলানা ছিলেন সোচ্চার। এ বৃহৎ অ লে বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, মকতব প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ তাঁর কাছ থেকে বায়’আত গ্রহণ কালে তাদেরকে ইসলামী রীতিনীতি, আইন কানুন, আমল, আখলাক বিষয়ে বিশেষ শিক্ষা দান করেন। মাওলানার সত্যপ্রিয়, তাকওয়া, পরহেজগারী এ অ লের মানুষের মুখে মুখে প্রবাদের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল অসাধারণ। এলাকায় তিনি পীর সাহেব হিসেবে খ্যাত ছিলেন। বাংলাদেশ ছাড়াও আসামে তাঁর শত শত ভক্ত রয়েছে। মাওলানার প্রত্যক্ষ দু’আয় নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত একটি সুরম্য মসজিদ ও ঐতিহ্যবাহী ফসিহ্ উল উলুম দাখিল মাদ্রাসা আজও দ্বীনের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
সন্তানাদি ও ইন্তেকাল: পারিবারিক জীবনে মাওলানা ২ পুত্র ও ৬ কন্যার জনক ছিলেন। তিনি ১৯৮৩ সালে ১ লা কার্তিক নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। নিজ বাড়ির সম্মুখস্থ মসজিদে মামা শরিফের সামনে তাঁর মাযার রয়েছে।
যেভাবে আসা যায়: দেশের যে কোন প্রান্ত হতে নবীনগর বাসসট্যান্ডে নেমে ইজিবাইক করে এখানে আসা যায়।
লেখক: মো: নাঈম ইসলাম, গণমাধ্যমকর্মী, শেরপুর।