বিজয় অর্জনের ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পাবনার ঈশ্বরদীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বধ্যভূমি আজ পর্যন্ত সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি তৈরি হয়নি শহিদদের তালিকাও। অথচ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক সোনালি ইতিহাস আছে এই ঈশ্বরদীর। শুধু সোনালি ইতিহাসই নয় রয়েছে নানারকম নির্মম ঘটনাও।
ঈশ্বরদী পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসতি গড়ে তুলেছিলেন তৎকালীন প্রায় ২১ হাজার অবাঙালি। এদের অত্যাচারে বাঙালিরা শহরে যাতায়াত করতে পারতেন না। অনেক বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের সেসময় ঈশ্বরদীর প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বাঙালি শহিদ হয়েছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যমতে, উপজেলার চিহ্নিত বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে ৩০টি। এসব বধ্যভূমির বাইরেও উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি। শহিদদের এসব গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো এখনও অযত্ন, অবহেলা আর দৃষ্টিসীমার বাইরেই রয়ে গেছে। এসব স্থানগুলো বর্তমানে ঘাস, ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। অনেক স্থান পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে। আবার কোথাও বসতবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত অফিস তৈরি করা হয়েছে। দেখে যেন বোঝার উপায়ই নেই এগুলো সেই ইতিহাস বহনকারী শহিদ হওয়া মানুষের গণকবর ও বধ্যভূমি।
স্বজন হারানো শহিদ পরিবারগুলোর দাবি, বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক যেন ভবিষ্যত প্রজন্ম এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমী মানুষের আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারে।
স্থানীয় কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে পাকসেনা ও তাদের দোসররা ঈশ্বরদীর বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিলেন। তাদের আগমনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে কিছু মানুষ নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। তারা ভেবেছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা মুসলিম তাই মসজিদে অন্তত হামলা করবে না। কিন্তু পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধন করতে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদেও হানা দিয়েছিলেন। ১২ থেকে ১৯ এপ্রিলের মধ্যে মসজিদ থেকে ধরে এনে ১৯ জনকে প্রেসক্লাব সংলগ্ন কয়লার ডিপোতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
এছাড়া আশেপাশের মহল্লা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করে গণকবর দিতো পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী।
পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালে কর্মরত আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. রফিক আহমেদ ও তার তিন ছেলেসহ পরিবারের পাঁচজনকে নিমর্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল এ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সেদিন তাদের বাসায় বেড়াতে আসা এক আত্মীয়কেও নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এই পাঁচ শহিদকে রাস্তার পাশে পানির ট্যাংকের কাছে সমাহিত করা হয় একটি গণকবরে। পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকশী পেপার মিল, অফিসার্স মেস ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুলিশ ফাঁড়িতে ক্যাম্প করেছিল এসকল পাকবাহিনী। এসব ক্যাম্পে বন্দিদের হত্যা করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। পাকশী রেলস্টেশনের বাম পাশের একটি জঙ্গলে অনেকের লাশ ফেলা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটিকে গণকবর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল অবাঙালিদের সহায়তায় লতিফ, আঁতু ও নান্নু নামে তিন সহোদরকে পাকশী রেল কলোনির ভেতরে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। কয়েকদিন পড়ে থাকার পর সুইপাররা লাশ তিনটি কলোনির মধ্যেই গর্ত করে মাটিচাপা দিয়ে দেন। সে সময় ঈশ্বরদী রেল জংশনই উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ বাঙালিরা এ পথে ট্রেনযোগে যাতায়াত করতেন।
ঈশ্বরদীর ফতেমোহাম্মদপুর এলাকায় তৎকালীন ২১ হাজার বিহারিদের বসতি ছিল। বিহারিরা ট্রেনে আগত যাত্রীদের ধরে গলা কেটে ও গুলি করে হত্যা করে। পরে হত্যার পর রেলের ফাঁকা জায়গায় অসংখ্য বাঙালিদের মাটিচাপা দিয়ে রাখে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঈশ্বরদী দখল করার দুদিন পর ১৩ এপ্রিল সকালে হামলা করে ঈশ্বরদীর কর্মকার পাড়ায় চন্দ্রকান্ত পালের বাড়িতে। বিহারিরা চন্দ্রকান্ত পাল, তার দুই ছেলে, দুই পুত্রবধূ, ছয় নাতি-নাতনি ও একজন দোকান কর্মচারীসহ ১২ জনকে কুপিয়ে হত্যা করে। সবাইকে বাড়ির একটি কূপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। শহরের মিলের পেছনের কাশবনে পাকসেনা ও রাজাকাররা প্রায় দুই শতাধিক নর-নারীকে নিয়ে এসে হত্যা করেছিলেন। এই বধ্যভূমি ও গণকবর আজও শনাক্ত করা হয়নি। পরবর্তীতে ২৩ এপ্রিল পাকসেনারা বাঘইল পশ্চিমপাড়ার একটি বাড়িতে ২৩ জন নর-নারীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে গ্রামবাসী লাশ গুলো একটি বিশাল গর্ত করে পুঁতে ফেলেছিলেন।
বিহারি-অধ্যুষিত ফতেহ মোহাম্মদপুর লোকোশেডে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় ১২ ও ১৩ এপ্রিল অসংখ্য বাঙালিকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করেছিল বিহারিরা। এ হত্যাযজ্ঞে সেখানে আজিজুল গনি, আব্দুল বারীসহ প্রায় ৩০-৩৫ জন বাঙালি শহিদ হন। ফতেহ মোহাম্মদপুর রেলওয়ে কলোনি অর্থাৎ লোকোশেড পাম্প হাউজ স্টেশনে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। এখানে হত্যার জন্য গুলির পরিবর্তে ধারালো তরবারি বা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হতো। রেলওয়ের এই পরিত্যক্ত পাম্প হাউজে কত বাঙালিকে যে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
লোকোশেডের উত্তর পাশে বর্তমান পানির ট্যাংকের পেছনে খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছোট বটগাছের নিচে রয়েছে একটি গণকবর। অথচ কোনো কবর বাঁধানো এমনকি নামফলক বা স্মৃতিচিহ্নই নেই যা দেখে মানুষ বুঝতে পারবেন এখানে মুক্তিযুদ্ধের জীবন উৎসর্গকারী বাঙালিরা ঘুমিয়ে আছেন। পৌর শহরের নুরমহল্লা এলাকার খেলার মাঠের উত্তর পাশেই রয়েছে আরেকটি গণকবর। এই গণকবরে ১০-১২ জন শহিদ ঘুমিয়ে আছেন। মাজদিয়া মাদরাসাপাড়ার একটি স্থানে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এলাকাটি এখনো জামায়াত-অধ্যুষিত বলে এই গণকবরগুলো চিহ্নিত করা হয়নি।
পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহিদ হওয়া মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা তহুরুল আলম মোল্লা জানান, ১৭ এপ্রিল মসজিদে ছিলেন তার বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন। পাকসেনা, রাজাকার ও বিহারিরা মসজিদের ভেতরে ঢুকে তাকেসহ বহু মুসল্লিকে ধরে এনে প্রেসক্লাবের পাশে কয়লা ডিপোর কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
আরেকজন বীরমুক্তিযোদ্ধা রেজাউল মোস্তফা বলেন, এ উপজেলার আরামবাড়িয়া গ্রামে আমার নিজ বাড়ি। সেখানে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হামলা চালিয়ে আমার মাসহ বেশ কয়েকজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন। এখন পর্যন্ত এ গণহত্যার স্থানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করা হয়নি।
ঈশ্বরদী মহিলা কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যাপক স্বপন কুমার কুন্ডু বলেন, আমার বাড়ি অবাঙালি-অধ্যুষিত পৌর এলাকার ফতেহ মোহাম্মদপুরের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো পৌর এলাকা অবাঙালিদের দখলে ছিল। কোনো বাঙালি শহরে আসতে পারতোনা। কেউ এলেই তাদের ধরে নিয়ে ফতেহ মোহাম্মদপুর পানির ট্যাংক ও রেললাইনের পাশে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলা হতো।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ আক্ষেপিত কণ্ঠে জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদদের কবর চিহ্নিত ও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিগত সরকারের আমলে উপজেলা পরিষদ ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হলেও সেটিও এখন আর নেই।
তিনি আরো বলেন, পাকবাহিনীর নৃশংসতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করে যেখানে সেখানে লাশ ফেলে রাখতো। এসব লাশ সৎকার করারও লোক ছিল না। আত্মীয়-স্বজনরাও লাশ নিয়ে যাওয়ার সাহস পাননি। চরম অবহেলায় সুইপাররা লাশগুলো গর্ত করে পুঁতে ফেলতেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে এসব বধ্যভূমি, গণকবর সংরক্ষণ ও নামফলক নির্মাণ অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
#ডেইলি-বাংলাদেশ