এ বছরের সবচেয়ে বড় ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য পুরো ফুটবলবিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। করোনাকালে জিভে জল এনে দেওয়া চ্যাম্পিয়নস লিগের এই ফাইনাল ম্যাচের দুই প্রতিপক্ষ বায়ার্ন মিউনিখ ও পিএসজি। দুই ক্লাবই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ইতিহাস গড়ার দ্বারপ্রান্তে।
২০১৯ সালের জুনে শুরু হওয়া এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের আসরের পর্দা নামতে চলেছে রোববার (২৩ আগস্ট) রাতে, যেখানে তর্ক সাপেক্ষে বিশ্বসেরা দলের মোকাবিলা করবে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ফরোয়ার্ড লাইন।
‘নিষ্ঠুর’ বায়ার্ন এবার তাদের গর্ব করার মতো ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো ট্রেবল জেতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এই দ্বারে পৌঁছানোর পথে তারা প্রত্যেক প্রতিপক্ষকে বিধ্বস্ত করে এসেছে। অন্যদিকে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরার অপেক্ষায় আছে ফরাসি চ্যাম্পিয়নরা।
১৩ পয়েন্টের স্পষ্ট ব্যবধান নিয়ে এবার বুন্দেসলিগা ঘরে তুলেছে বায়ার্ন। একইসঙ্গে জার্মান কাপের শিরোপা গেছে বাভারিয়ানদের ঘরে। এবার ইয়ুপ হেইঙ্কসের দলের গড়া ২০১২/১৩ মৌসুমের ট্রেবল জয়ের কীর্তি ছোঁয়ার পথে হ্যান্সি ফ্লিকের দল।
এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের আসরে সব প্রতিপক্ষকে অনায়াসে হারিয়েছে বায়ার্ন। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট ও পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনাকে ৮-২ গোলে বিধ্বস্ত করে তারা নিজেদের আসল রূপ দেখিয়েছে।
চ্যাম্পিয়নস লিগের চলতি আসরে মাত্র ১০ ম্যাচে ৪২ গোল করেছে বায়ার্ন। এর মধ্যে গ্রুপ পর্বে টটেনহামের বিপক্ষে দুই লেগে ১০ গোল এবং চেলসির বিপক্ষে শেষ ষোলোর দুই লেগে ৭ গোলও আছে। এর মধ্যে বায়ার্নের পোলিশ স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডভস্কি এখন পর্যন্ত একাই করেছেন ১৫ গোল।
বায়ার্নকে ষষ্ঠ ইউরোপিয়ান কাপ জেতা থেকে বঞ্চিত করতে পিএসজির কাছে আছে নেইমার, কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং আনহেল দি মারিয়াকে নিয়ে গঠিত বিশ্বসেরা ফরোয়ার্ড লাইন।
পিএসজির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৯ ম্যাচ খেলে নেইমার এখন পর্যন্ত ২৪টি গোলে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন, যার মধ্যে ১৪টি গোল নিজে করেছেন এবং ৯টি সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন। এবার পিএসজিকে শিরোপা জেতাতে পারলে ২০১৭ সালে তার ২২২ মিলিয়ন ইউরোর ট্রান্সফার ফি’র বিশ্বরেকর্ড গড়ে বার্সা ছেড়ে প্যারিসে যাওয়াও সার্থক হবে।
চলতি আসরের শেষ ষোলো থেকেই পিএসজিতে নেইমারকে সত্যিকার অর্থেই সুখী মনে হচ্ছে। আগের দুই মৌসুমে ইনজুরি,মাঠের বাইরের বিতর্ক আর বার্সায় ফেরা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা মিলিয়ে তাকে কখনোই আগের মতো মনে হয়নি। কিন্তু সবাই জানে, ফর্মে থাকলে তিনি এমন একজন খেলোয়াড় যিনি একাই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারেন।
এবার নিয়ে ১১তম বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছে বায়ার্ন। একমাত্র রিয়াল মাদ্রিদ (১৬) তাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। এবারের আসরে ১০ ম্যাচ খেলে সবগুলোতেই জয় পাওয়া বায়ার্ন ডিফেন্স নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে, বিশেষ করে লিঁওকে সেমিফাইনালে ৩-০ গোলে হারানোর ম্যাচে প্রতিপক্ষ বেশ কয়েকটি সুযোগ হাতছাড়া না করলে ফলাফল অন্যরকমও হতে পারত।
অন্যদিকে পিএসজির পুরো নির্ভরতা তাদের আক্রমণভাগকে ঘিরে। প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠা দলটি ৪১তম ফাইনালিস্ট। ইউরোপের অন্যতম খরুচে ক্লাব হওয়া সত্ত্বেও অর্জনের খাতায় কম মার্ক পাওয়া দলটি এবার সত্যিকার অর্থেই শক্তিশালী। বিশেষ করে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সাবেক কোচ টমাস টুখেল দলটিকে দারুণভাবে সাজিয়েছেন।
পিএসজির বর্তমান ফর্মের পেছনে বড় অবদান অবশ্যই টুখেলের। ভারসাম্যপূর্ণ দল গঠনের পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় নেইমারকে সুখে রাখার কাজটাও বেশ ভালোভাবেই করেছেন তিনি। ফলে প্যারিসে পা রাখার পর নিজের সেরা ফর্মে দেখা দিয়েছেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। ফাইনালে টুখেলের বাজির ঘোড়াও নেইমারই।
পিএসজির জন্য সুখবর হচ্ছে দলের আরেক সেরা তারকা এমবাপ্পেও পুরো ফিট হয়ে ফিরছেন। ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী ফরোয়ার্ড সেরা ফর্মে থাকলে একাই একশ। সঙ্গে আছেন ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় ফর্মে ফেরা আনহেল দি মারিয়া। তবে মিডফিল্ড আর নেইমারের মধ্যে যে যোগসূত্র দেখা যাচ্ছে এটাই পিএসজির জন্য স্বস্তির কারণ। দলটাকে ‘নেইমারের দল’ বানানোর জন্য টুখেল ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল যেখানে পিএসজির জন্য নতুন অভিজ্ঞতা, সেখানে বায়ার্ন এখানে অতি পরিচিত মুখ। এত বড় ম্যাচে খেলার অভিজ্ঞতা তাদের অনেকবারই হয়েছে। কিন্তু পিএসজির জন্য এটা ‘এখন নয়তো কখনোই নয়’ অবস্থা। কারণ এই শিরোপা জিতলে ইউরোপের এলিটদের তালিকায় জায়গা করে নেবে।
শুধু কি তাই, ইউরোপ সেরার মুকুট জিতলে নেইমার, এমবাপ্পের মতো সুপারস্টারদের দিকে শীর্ষ ক্লাবগুলোর লোভাতুর দৃষ্টিও রুখে দিতে পারবে পিএসজি। আর শীর্ষ কোচদের তালিকায় চলে আসবেন টুখেল।
অন্যদিকে এবারের শিরোপা জেতা বায়ার্নের জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারা যে ইউরোপের সেরা দল তা প্রমাণ করতে হলে শিরোপাটা জিততেই হবে। কারণ ঘরোয়া লিগের শিরোপা জিতে জিতে দলটি ক্লান্ত। তবুও ইউরোপীয় পর্যায়ে তাদের বার্সা-রিয়াল-লিভারপুলের সমপর্যায়ের গণ্য করা হয় না। এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার তীরে এসে তরী ডুবিয়েছে। ফলে এবারও শিরোপা হাতছাড়া হলে এত এত অর্জনের কোনো মূল্যই থাকবে না।
বায়ার্নের সবচেয়ে বড় ভরসা নিঃসন্দেহে লেভানডভস্কি। চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা ৯ ম্যাচে গোল করা এই পোলিশ স্ট্রাইকার আর ২ গোল করতে পারলেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর (এক আসরে ১৭ গোল) রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবেন। তবে সার্জ ন্যাব্রির কথা ভুলে গেলে চলবে না। লিঁওর বিপক্ষে সেমিফাইনালে দলের ৩ গোলের ২টিই এসেছে তার পা থেকে। ২০১৩ সালের পর শিরোপা জিততে মরিয়া দলে আছে ‘সব্যসাচী মেশিন’ টমাস মুলার। সবমিলিয়ে টানটান উত্তেজনার এক ফাইনাল অপেক্ষা করছে।