সরকারের ১৪ লাখের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য প্রতিষ্ঠিত সাতটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। দেশের ৮টি বিভাগে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ঢাকায় তিনটিসহ এই মোট সাতটি ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। ঢাকার বাইরে বগুড়া, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনায় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থাকলেও রাজশাহী, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে কোনও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। তাই এসব বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মামলা করতে অন্য বিভাগের ট্রাইব্যুনালে যেতে হয়। এতে এসব বিভাগের সরকারি কর্মচারীরা পড়েন ভোগান্তিতে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য কিছু গণপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের চাকরির মেয়াদ, শর্তাবলি, সরকারি বাসা, বেতন-ভাতা, ও পেনশন সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য সরকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৮০ (১৯৮১ সালের ৭ নং আইন) এর আওতায় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৭ অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের বিধান রাখা হয়েছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট ১৯৮০ (১৯৮১ সালের অ্যাক্ট-৭) বলে বাংলাদেশে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এ আইনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হলো প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তির চাকরির শর্ত সম্পর্কিত বিষয়ে বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। আইনের ৩ ধারার ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে ১ জন সদস্য নিয়ে। আর তিনি জেলা জজ সমমর্যাদার একজন হবেন। জেলা জজ সমমর্যাদার বাইরে কেউ এ ট্রাইব্যুনালে সদস্য হবার যোগ্য হবেন না।
আইনে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সকল কর্মচারী ও সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থায় যারা কর্মে নিযুক্ত তার তাদের পেনশন ও চাকরির শর্তাবলি বা তার বিরুদ্ধে যদি কোনও কার্যধারা গ্রহণ করা হয় সে বিষয় নিয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারবেন। আর এই মামলাগুলো এই ধারা অনুযায়ী অবশ্যই এই ট্রাইব্যুনালেই করতে হবে।
জানা গেছে, প্রজাতন্ত্রের কোনও কর্মচারী তার মৌলিক অধিকারের বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হলে তাকে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৮০ অনুযায়ী প্রথম তার বিভাগ বা রাষ্ট্রপতির কাছে রিভিউ আবেদন করতে হয়। এরপর যেতে হয় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে। প্রশাসনিক টাইব্যুনালের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে এরপর প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে যেতে হয়। আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রতিকার চাইতে পারবেন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে। সংসদ আইনের দ্বারা একাধিক প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বলে উল্লেখ রয়েছে। তাই বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার চাইলে এ ধরনের ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে বলেও আইনে ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকের দফতরের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আমরা জেলা পর্যায়ে কাজ করি। জেলার বাইরে আমাদের তেমন কোনও বদলি করা হয় না। অনেক সময় অনেক জেলা প্রশাসকের মন জুগিয়ে কাজ করতে না পারলে তারা অন্যায় আচরণ করেন। এ বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আমরা নিজের বিভাগের বাইরে স্থাপিত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হই। এতে সময় ও অর্থের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের যে কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হলে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করতে পারতেন। এখন পারেন না। কারণ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থাকা সত্ত্বেও তারা সেখানে না গিয়ে সরাসরি হাইকোর্টে রিট করেন। বর্তমানে হাইকোর্টে এ ধরনের রিট মামলার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চলতি বছরের এপ্রিলে এ সংক্রান্ত একটি মামলা নিষ্পত্তি করে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে। ওই রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, চাকরির শর্তাবলিতে ক্ষুব্ধ হলেও সরকারি চাকরিজীবীরা এখন আর সরাসরি হাইকোর্টে রিট করতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, হাইকোর্টে রিট মামলা হিসেবে বিচারাধীন ১০ হাজারেরও বেশি মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রশাসনিক টাইব্যুনালে ফেরত পাঠিয়েছে আপিল বিভাগ।
তবে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালগুলোকে অন্তর্বর্তীকালীন যেকোনও স্থগিতাদেশ বা নিষেধাজ্ঞা জারির এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, হাইকোর্টের ওই ১০ হাজারের বাইরে ঢাকার তিনটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি। বাকি চারটি ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে ৭টি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে এখন বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। কিন্তু ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট, রংপুরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মামলা করতে তাদের নিজ নিজ বিভাগের বাইরে প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে যেতে হয়। যা তাদের জন্য দুর্ভোগের কারণ।
প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বর্তমানে যে কয়টি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে সে কয়টিই কাজ করবে। আপাতত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোর কোনও পরিকল্পনা বা উদ্যোগ সরকারের নেই বলেও জানান তিনি।