যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য ও স্ত্রী তন্দ্রা ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ৫০ কোটি ৬৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৪৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মঙ্গলবার মামলা দুটি করা হয়েছে। দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম একটি মামলায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য ও স্ত্রী তন্দ্রা ভট্টাচার্যকে আসামি করেছেন। অপর মামলায় স্বপন ভট্টাচার্যকে আসামি করেছেন দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আল-আমিন। মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদক যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আল আমিন। এদিকে ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে থাকায় স্বপন ভট্টাচার্য দম্পতির বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। বুধবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে কল দিলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
জানা যায়, ২০০৯ সালে মনিরামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন স্বপন ভট্টাচার্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর স্বপন ভট্টাচার্য ও তার পরিবারের সদস্যরা অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারে মেতে উঠেন। ২০১৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব পান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর। এক মেয়াদে উপজেলা চেয়ারম্যান, দুই মেয়াদে সংসদ-সদস্য এবং প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে স্বপন ভট্টাচার্য, তার স্ত্রী তন্দ্রা ভট্টাচার্য, ছেলে সুপ্রিয় ভট্টাচার্য ও ভাগনে উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চুসহ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে লাগামহীন দুর্নীতি ও দলীয় প্রতিপক্ষকে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগ। পাচার করা টাকায় দেশের বাইরে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে স্বপন ভট্টাচার্য ও তন্দ্র ভট্টাচার্যের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের সত্যতা মিলেছে।
দুদকের করা মামলার প্রথম এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য ও তার স্ত্রী পরস্পর যোগসাজশে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ পাঁচ কোটি ৫৫ লাখ ৪৫ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করে ভোগ দখলে রেখেছেন। নিজ নামে ১০টি ব্যাংক হিসাবে মোট ১০ কোটি ৩৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জমা এবং মোট সাত কোটি ৫০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা উত্তোলনপূর্বক সন্দেহজনক লেনদেন করে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে মানি লন্ডারিং করেছেন। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছেন-অনুসন্ধানকালে আসামি তন্দ্রা ভট্টাচার্যের নামে কোনো স্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়নি। তার নামে ব্যবসায়িক পুঁজি, আসবাবপত্র, স্বর্ণালংকার ও বিভিন্ন ব্যাংক স্থিতিসহ মোট ৬ কোটি ১২ লাখ ১৪ হাজার টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। আয়কর নথি অনুযায়ী তন্দ্রা ভট্টাচার্যের পারিবারিক ব্যয় পাওয়া যায় ৬০ লাখ ৩১ হাজার ৬৯৩ টাকা। ব্যয়সহ তার মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ কোটি ৭২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৯৪ টাকা। এই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে আয়কর নথি খোলার সময় পূর্ববর্তী সঞ্চয়, ২০০৮-০৯ হতে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত গৃহ সম্পত্তির আয়, করমুক্ত আয়সহ মোট ১৭ লাখ ৪শ টাকার আয় পাওয়া যায়। ঋণসহ মোট আয়ের পরিমাণ ১ কোটি ১৭ লাখ ৪০৩ টাকা। এক্ষেত্রে তন্দ্রা ভট্টাচার্যের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ পাওয়া যায় ৫ কোটি ৫৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বপন ভট্টাচার্য অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধমূলক অসদাচরণ করে প্রভাব ও আর্থিক সহায়তায় তার স্ত্রীর জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে ওই সম্পদ অর্জনে সহায়তা করে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
তাছাড়া তন্দ্রা ভট্টাচার্যের নিজ নামে ১০টি ব্যাংক হিসাবে মোট ১০ কোটি ৩৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জমা এবং ৭ কোটি ৫০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। যা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেন। তিনি তার স্বামী স্বপন ভট্টাচার্যের ক্ষমতা ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে মানি লন্ডারিং সম্পৃক্ত অপরাধ (দুর্নীতি ও ঘুস) সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন করার উদ্দেশ্যে রূপান্তর, স্থানান্তর ও হস্তান্তর করে মানি লন্ডারিং করেছেন।
দ্বিতীয় এজাহারে উল্লেখ করা হয়, স্বপন ভট্টাচার্য অসৎ উদ্দেশ্যে নিজ স্বার্থে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তিনি অবৈধ উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ২ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করে ভোগ দখলে রেখেছেন। নিজ নামে ১৯টি ব্যাংক হিসাবে মোট ৪১ কোটি ৬৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা জমা করেছেন। মোট ৪০ কোটি ৩১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অস্বাভাবিক লেনদেন করে মানি লন্ডারিং সম্পৃক্ত অপরাধ করেছেন। তিনি ‘দুর্নীতি ও ঘুস’ সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন করার উদ্দেশ্যে হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করতে এই ৪০ কোটি ৩১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন।
দুদক যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আল-আমিন বলেন, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা দুটি দায়ের হয়েছে।
যুগান্তর