পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের হোসেনি দালান চত্বরে রবিবার (৩০ আগস্ট) সকাল থেকে জড়ো হতে থাকেন ভক্তরা। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দুটি গেটে জীবাণুনাশক টানেলের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে হয় তাদের। এবার সরকারের নির্দেশে তাজিয়া মিছিল মূল সড়কে করতে না পারায় ক্ষোভ ভক্তদের মনে। হোসেনি দালানে প্রবেশে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হলেও প্রবেশের পর খুলে ফেলেন অনেকেই। ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ করে বুক চাপড়ে শোকের মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে হোসেনি দালান চত্বরেই। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইমামবাড়ায় অনুষ্ঠান করার কথা থাকলেও তা কেউ মানেননি।
আরবি ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) শহীদ হন। তাঁর মৃত্যুর এ দিনটিতে শোক প্রকাশ করে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় বের করেন তাজিয়া মিছিল। পবিত্র আশুরার এ দিনটিকে মুসলিম বিশ্বে ত্যাগ ও শোকের দিন হিসেবে পালন করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্য দিয়েই হোসেনি দালানে প্রবেশ করেন ভক্তরা। ভক্তদের ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে সামাজিক দূরত্ব। সকাল ১০টার দিকে শোকের স্মৃতি নিয়ে হোসেনি দালানের সীমানার ভেতরেই হয় তাজিয়া মিছিল। শোক প্রকাশে বুক চাপড়ে মাতম করেন মিছিলে উপস্থিত ব্যক্তিরা। শোকের বহিঃপ্রকাশে কালো পোশাকে উপস্থিত ছিলেন অনেকে। ছেলেরা কালো রঙের কাবলি, পাঞ্জাবি, আর নারীরা কালো সালোয়ার কামিজ পরেছেন বেশি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ছিল শিশুরাও।
শুধু মুসলমান নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যোগ দিয়েছেন তাজিয়া মিছিলে। রাজধানীর বংশাল থেকে মিছিলে এসেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী হীরা মনি। তিনি বলেন, ‘আমার মাও আসতেন, ছোট থেকে আমরা আসি। এ হোসেনি দালানে এসে আমার মা মানত করেছিলেন, সেটি পূরণ হয়েছিল। আমি আমার সন্তানদেরও নিয়ে এসেছি।’
সীমিত আকারে হওয়ার কারণে এবার মিছিলে মানুষের উপস্থিতি ছিল বিগত বছরের তুলনায় কম। ঐতিহ্যগত বিষয়গুলো ঠিক রাখতে মিছিলের শুরুতেই বিবি ফাতেমার স্মরণে দুটি কালো গম্বুজ বহন করা হয়। অনেকেই সেখানে চুমু ও ছুয়ে সালাম জানান। মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন পতাকা নিয়ে আসেন, তবে সেগুলোর উচ্চতা আগের চেয়ে কম। মিছিলের মধ্যে একদল যুবক শোকের গান ধরেন, হায় হোসেন, হায় হোসেন করে। অন্যারাও তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। মিছিলের মাঝে দুটি ঘোড়া ছিল, যার মধ্যে একটি লাল রঙ দিয়ে রক্তের রূপ স্মৃতিচারণ করা হয়েছে। অনেকেই নানা নিয়ত করে সেই ঘোড়াগুলোর পা দুধ দিয়ে ধুয়ে দেন। কেউ কেউ আবার সেই দুধ তুলে গায়ে মাখেন, কেউ মুখে। আর কেউ কেউ সেই দুধ খান রোগ মুক্তির জন্য। মিছিলের একেবারে শেষে তাজিয়া তৈরি করা হয় ইমাম হোসেন (রা.)-এর সমাধির আদলে।
নারী-পুরুষের পাশাপাশি শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণে তাজিয়া মিছিল শেষ হয় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। তবে মূল সড়কে যেতে না পারায় অনেকেই ক্ষুব্ধ হন।
ছোট বেলা থেকেই তাজিয়া মিছিলে আসেন কাজী মো. দেলোয়ার হোসেন। ৭৮ বছরে এসে এই প্রথম হোসেনি দালানের ভেতরে মিছিল দেখছেন তিনি। মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাপ-দাদারা তাজিয়া মিছিলে আসতেন, আমিও আসছি ছোট বেলা থেকে। কিন্তু কখনও তাজিয়া মিছিল বন্ধ হয়নি। এবার যা হয়েছে তা বন্ধের মতোই। কেউই এমন পরিস্থিতি আশা করেনি।’
হোসেনি দালান ইমাম বাড়ার বেহেস্তা সরদার নূর মোহাম্মদ ইবনে লালা বলেন, ‘সরকার নির্দেশ দিয়েছে, আমরা তা মেনে চলছি। সব নির্দেশনা অনুসরণ করেই আয়োজন চলছে।’
ধীরে ধীরে নানাভাবেই সংকোচিত হয়ে আসছে তাজিয়া মিছিল। এ মিছিলের মূল লক্ষ্য কারবালার ইতিহাস উপস্থাপন ও শোক প্রকাশ। কারবালার রক্তাক্ত স্মৃতির স্মরণে মিছিলে বুক চাপড়ে, জিঞ্জির (একাধিক ধারালো ছুরি বা ব্লেড দিয়ে তৈরি) দিয়ে শরীরে আঘাত করে মাতমের রেওয়াজ ছিল দীর্ঘ দিন ধরেই। ২০১৫ সালের এই দিনে জঙ্গিরা হোসেনি দালানের ইমামবাড়ায় বোমা হামলা চালিয়েছিল। এর পর তাজিয়া মিছিলে দা, ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি ইত্যাদি বহন এবং আতশবাজি ও পটকা ফোটানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। তবে বিগত ৫ বছর ধরে পুলিশের নির্দেশনা অনুসারে জিঞ্জির দিয়ে শরীরে আঘাত করে রক্ত ঝরিয়ে শোকের মাতাম আর হয় না। এছাড়া, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি ইত্যাদি বহন করে তাজিয়া মিছিলে অংশগ্রহণও বন্ধ হয়ে যায়। কারবালার শোকের সঙ্গে এবার নতুন করে করোনাভাইরাস শোক বাড়িয়েছে শিয়া সম্প্রদায়ের। প্রায় সবার মধ্যে মূল সড়কে তাজিয়া মিছিল করতে না পারার ক্ষোভ রয়েছে।