সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলায় প্রায় ২৫ হাজার আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বসবাস রয়েছে। জেলায় গারো, কোচ, হাজং, ঢালু, বানাই ও বর্মনসহ মোট ৬টি নৃ-গোষ্ঠি জাতীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গারো সম্প্রদায়। যুগ যুগ ধরে তারা নানা ভাবে অবহেলিত রয়েছে।
এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বা গারো আদিবাসী নারীরা এক সময় পিঠে তাদের সন্তানদের ঝুলিয়ে ক্ষেতে-খামার ও হাট-বাজারে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য খুব চোখে পড়তো। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক নানা পরির্বতন এবং সময়ের চাহিদা’র কারণে সে দৃশ্য এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না।
এখন তারা ফসলের ক্ষেতে কাঁদা-মাটি ছেড়ে উঠে আসছে শিক্ষিত সমাজের বিভিন্ন দপ্তর ও কর্মক্ষেত্রে। একই সাথে তারা দক্ষতার সাক্ষর রেখে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছে দিন দিন।
জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলার মরিয়মনগর খ্রীষ্টান মিশন এলাকায় দুধনই ও ভারুয়া গ্রামের শত শত নারী নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকতে নিজেদের সাংস্কৃতি ও রীতিকে পাশ কাটিয়ে পার্লার ব্যবসায় গিয়ে স্বাবলম্বীর পথে অনেক দুর এগিয়ে গেছে।
কয়েক বছর আগেও যাদের চুলোয় আগুন জ্বলতো দিনের এক বেলা বা দু’বেলা। এখন ওইসব পরিবারের বাঁশ ও খড়ের এক চালা ঘর পরিবর্তন হয়ে ইটের দালান হচ্ছে। এসব নারীদের মধ্যে বেশির ভাগই রয়েছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
উল্লেখিত গ্রামের প্রতি বাড়িতেই ২ থেকে ৫ জন করে নারী এ পার্লায় ব্যবসা এবং শ্রমিক হিসেবে জেলা শহরের পাশপাশি ঢাকা-চট্টগ্রামের শতাধিক পার্লারে বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। এদের অনেকই এখন প্রথমে ঢাকা-চট্টগ্রামে কাজ শিখে শেরপুর এবং ঢাকাতেও নিজেরাই পার্লার ব্যবসার মালিক বণে গেছেন। ফলে এদের ভাগ্যের চাকা এখন আকাশ চুম্বির দিকে ছুটে যাচ্ছে।
ঢাকায় একটি পার্লারে কাজ করেন লিছা চাম্বু গং ও তার বোন মাধুরী চাম্বু গং। লিছা জানায়, পড়াশোনার পাশপাশি ঢাকায় অনেক আদিবাসী নারী পার্লারে কাজ করছে এবং তাদের পরিবারে আর্থিক সহায়তা করছে।
মাধুরী চাম্বু গং বলেন, আমাদের আগে গারো বলে কোন দাম দিত না। এখন আমাদের আয় উন্নতি হওয়ায় আনেকেই দাম দেয়।
ঢাকায় পার্সোনা বিউটি পার্লারে কাজ করেন তৃণা ম্রং। সে জানায়, আমাদের আগে অনেক অভাব ছিল। আমি প্রায় ১০ বছর আগে ঢাকায় একটি পার্লারে কাজ নেই। বর্তমানে আছি পার্সোনায়। এখানে কাজ করে আমি বেশ ভালো আয় করছি। বর্তমানে আমার জমানো টাকা দিয়ে বাড়িতে পাকা ঘর নির্মান করছি।
শেরপুরের বেবী বিউটি পার্লারের স্বত্বাধিকারী পানেলা রাকসাম জানায়, আমার মতো অনেক আদিবাসী নারী তাদের পারিবারের সমস্যার কারণে ঢাকায় কাজ শিখে এসে নিজ এলাকা শেরপুরে বিভিন্ন পার্লারে কাজ করছে এবং পরিবারকে সহযোগীতা করছে।ঢাকায় কাজ শিখে কিছুদিন ঢাকায় থেকে পরবর্তিতে শেরপুরে এসে পার্লারের মালিক হয়ে অনেকেই ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে।
মরিয়মনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অঞ্জন আরেং জানায়, আশির দশকে এ এলাকার নারীরা ক্ষেত খামারে কাজ করলেও আশির দশকের পর তারা তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য জেলার বাইরে ঢাকায় বিভিন্ন পার্লারে গিয়ে কাজ করে উন্নতি করছে।
আদিবাসী নেত্রী ও ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন (টিডব্লএ) এর সাবেক চেয়ারম্যান, রাবেতা ম্রং জানায়, এক সময় আমাদের আদিবাসী নারীরা পিঠে শিশুদের নিয়ে মাঠে কাজ করতো। সেসময় তাদের কৃষি কাজের বিকল্প ছিল না। প্রত্যন্ত এ অঞ্চলের সাথে জেলা সদর ও রাজধানী ঢাকার যোগগাযোগ ভাল হওয়ার পর আদিবাসী নারীরা এ অভাবে সংসার থেকে বেড়িয়ে এসে লেখা-পড়া শিখে বেশ ভালো অবস্থায় উঠে আসছে। তারা লেখাপড়ার পাশপাশি নিজের পায়ে দাড়িয়ে অভাবী সংসারের হাল ধরছে। বিশেষ করে এলাকার শত শত গারো নারী এখন পার্লার ব্যাবসায় গিয়ে বেশ ভালো করেছে। বর্তমানে কাজের দক্ষতার করনেই পার্লার ও হোটেল এটেনটেন্স এ গারো নারীদের বেশ কদর রয়েছে।
সূত্র: আলোকিত শেরপুর