গণপরিবহণে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির খবর আমরা প্রায়ই পাই। কখনো কখনো এসব ঘটনায় ব্যাপক প্রতিবাদও হয়। কিন্তু এর মাত্রাটি কোন পর্যায়ে তা হয়তো আমরা বুঝতে পারিনা। সম্প্রতি দু’টি গবেষণায় এর ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণা দু’টি করেছে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এবং ব্র্যাক। এর মধ্যে সবশেষ গবেষণাটি প্রকাশ করেছে অ্যাকশন এইড, যার শিরোনাম ‘সেফ সিটিজ ফর উইমেন’। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ গণপরিবহণের চালক ও হেলপারদের দ্বারা হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন। নারীর ওপর শারীরিক যৌন হয়রানির বিষয়ের বাইরে এই যে মানসিক যৌন হয়রানি, তা তেমন আমলে নেয়া হচ্ছেনা। কিন্তু এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এর শিকার নারীরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না যে, তারা কোথায় কীভাবে এর প্রতিকার পাবেন।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ইকুয়িটি ম্যানজোর কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ‘আমরা সাধারণভাবে পাবলিক পরিবহণে ধর্ষণসহ নানা ধরণের যৌন হয়রানির কথা জানি। এবার আমরা যৌন নির্যাতনে শব্দের ব্যবহারকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। এতে দেখা যায়, ঘরের বাইরে নারী যে যৌন হয়রানির শিকার হয়, তা প্রধানত চলাচলের পথে এবং পরিবহণে। এটা বাড়ছে কারণ এর প্রতিকার পাওয়া যায়না। পথে ট্রাফিক পুলিশ বা পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ করলে তারা এটা আমলে নেয়না। উলটো খারাপ মন্তব্য করে। আর বাসের মধ্যে বা বাস মালিকদের কাছে অভিযোগ করার কোনো পদ্ধতি আমাদের এখানে নেই’।
২০১৮ সালে ব্র্যাক গণপরিবহণে যৌন হয়রানি নিয়ে আরেকটি গবেষণা করে। এতে দেখা যায়, গণপরিবহণে যাতায়াতকালে ৯৪ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। এই যৌন হয়রানির জন্য যারা দায়ী তাদের বড় অংশ ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষ, শতকরা হিসেবে তারা ৬৬ ভাগ।
যৌন হয়রানির নানা ধরণ: শারীরিকভাবে যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করা বা চিমটি কাটা, কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো বা আস্তে ধাক্কা দেয়া, নারীদের চুল স্পর্শ করা বা কাঁধে হাত রাখা ইত্যাদি।
ঘটনার শিকার হলে মেয়েরা কী পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন? এই প্রশ্নের উত্তরে গবেষণা জরিপে অংশ নেয়া ৮১ শতাংশ নারী বলেছেন তারা চুপ করে থাকেন। আর ৭৯ শতাংশ বলেছেন তারা আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যান।
ব্র্যাক-এর জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের সমন্বয়কারী হাসনে আরা বেগম বলেন, ‘প্রচলিত যৌন হয়রানির পদ্ধতিগুলোর বাইরে এখন মোবাইল ফোনে ছবি তুলে নিয়ে হয়রানি করার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আর পরিস্থিতির কারণেই অধিকাংশ নারী অভিযোগ করেন না’।
তিনি বলেন, ‘তবে আশার কথা হলো গণপরিবহণে এই যৌন হয়রানি নারীকে থামিয়ে রাখতে পারছেনা। এত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সে কাজে যাওয়া থেকে বিরত থাকছেনা’।
যৌন হয়রানির প্রতিকার সম্পর্কে হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘আমাদের দেশে গণপরিবহণ নীতিমালা নেই। আর যৌন হয়রানির আইন সুনির্দিষ্ট নয়। এব্যাপারে শুধুমাত্র উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা আছে। তাই প্রয়োজন গণপরিবহণ নীতিমালা এবং সুনির্দিষ্ট আইন। এর সঙ্গে প্রয়োজন সচেতনতা’।
তিনি বলেন, ‘পরিবহণ মালিকদের দায় দায়িত্বের আওতায় আনতে হবে। অভিযোগ দেয়ার সহজ পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। আর গণপরিবহণে সিসি ক্যামেরা লাগানোর যতদূর সম্ভব ব্যবস্থা করতে হবে’।
কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ‘চালক ও হেলপারদের জেন্ডার বিষয়ে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। তাদের এই প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর এই দায়িত্ব নিতে হবে পরিবহণ মালিকদের। সবার ওপরে নারীর প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে কাজ করতে হবে। পরিবহণগুলোকে করতে হবে নারী বান্ধব’।