মাটি খুঁড়ে গর্ত করে সেই গর্তে ১৭ বছর ধরে বসবাস করছেন গৃহহীন রুহুল আমিন ও রেহেনা দম্পতি। শীতসহ ঝড়-বৃষ্টি সবই তাদের সইতে হয় নিদারুণ কষ্টে। দীর্ঘ ২৫ বছরের সংসার জীবনে একটি ছোট্ট ঘর তুলতে পারেননি টাকার অভাবে।
তিন সন্তানের প্রতিপালন করতে না পারায় একজনকে দত্তক দিয়েছেন সাত দিন বয়সেই। বাকি দুই সন্তানের একজনকে বাধ্য হয়ে বিয়ে দিয়েছেন সতিনের ঘরে। ছোট মেয়েটিকেও পড়ালেখা করাচ্ছেন গ্রামবাসীদের সহায়তায়।
রুহুল আমিনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের দিঘরিয়া গ্রামের সরদার পাড়ায়।
প্রতিবেশী ও স্বজনেরা জানান, স্বামী দিন মজুর, স্ত্রীও কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। প্রায়ই অসুস্থ থাকায় কাজে যাওয়া হয় না রুহুলের, ফলে স্ত্রীর আয়েই কোনো রকমে চলে সংসার। টাকার অভাবে মেয়েকে আনা হয় না শ্বশুর বাড়ি থেকে। ছোটমেয়েটির লেখাপড়ার খরচ চলে অন্যের দানে। সরকার বা বিত্তবানেরা সহায়তার হাত না বাড়ালে বন্ধ হয়ে যাবে মেয়ের লেখাপড়া, কখনোই নির্মাণ হবে না একটি ঘর।
মো. রুহুল আমিন ও মোছা. রেহেনা খাতুন বলেন, ১৯৯৭ সালে তারা বিয়ে করেন। দিঘরিয়া দিয়ার পাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থেকেছেন পাঁচ বছর। তিন বছর থেকেছেন দিঘরিয়া সরদার পাড়ায় মামার বাড়িতে। কিন্তু মামাতো ভাইয়ের বিয়ের পর বাধ্য হয়ে ঘর খালি করে দিতে হয়। এরপর চলে আসেন পৈতৃক ভিটায়। সেখানে সামান্য জায়গা ছিল। সেই জায়গায়ই গর্ত করে রয়েছেন প্রায় ১৭ বছর।
তারা আরও বলেন, মাটির গর্তের মধ্যে থাকতে অনেক সমস্যা হয়। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় গর্তের ভেতর ও চারপাশ স্যাঁতসেঁতে থাকে। মাটির ভেতর থেকে পোকা-মাকড় বেরিয়ে পড়ে। জীবনযাপনের জন্য যে দু-চারটি আসবাবপত্র রয়েছে সেসব নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া শীতে ভীষণ কষ্ট হয়। আমাদের মাথার ওপর ছাদ নেই। শীত নিবারণের তেমন গরম কাপড়ও নেই।
এসব কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেন রেহেনা খাতুন। তিনি বলেন, সংসারের চিন্তায় তার স্বামী রুহুল আমিনের অসুখ লেগেই থাকে। এরপরও দিন মজুরি করেন। কিন্তু একজনের রোজগারের টাকায় পাঁচজনের সংসার চালানো অসম্ভব। অভাবের তাড়নায় মেজ মেয়ে মীমকে মাত্র এক সপ্তাহ বয়সে দত্তক দিয়েছি। বড় মেয়ে বিলকিস খাতুনকে সতিনের সংসারে বিয়ে দিয়েছি। জামাই ও মেয়েকে বাড়ি আনতে পারছি না; ঘর না থাকার জন্য।
তিনি বলেন, ছোট মেয়ে মিতু পড়ালেখায় ভালো। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে বারুহাস উচ্চবিদ্যালয়ে। সমাজের বিত্তবানদের মধ্যে কেউ মেয়েটার পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করার দায়িত্ব নিলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারত।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাটি খুঁড়ে ঘর বানিয়ে সেই ঘরের মধ্যে রয়েছেন রুহুল আমিন, তার স্ত্রী রেহেনা খাতুন ও মেয়ে মিতু খাতুন। গর্তের ঘরের ওপর ত্রিপল দিয়ে রেখেছেন। সেই ত্রিপল বাঁশ ও ইটের সমন্বয়ে চাপ দিয়ে রাখা হয়েছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে গর্তের পাশে ত্রিপল দিয়েই বেড়া দেওয়া হয়েছে।
উঠানের তুলনায় গর্তের চারপাশ মাটি দিয়ে উঁচু করা। গর্তের মধ্যে রয়েছে একটি সোয়ার চৌকি, নামাজের জন্য নির্ধারিত একটি ছোট চৌকি ও একটি বাক্স।
দিঘরিয়া সরদার পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা ও সলঙ্গা ডিগ্রি কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রভাষক আলাল উদ্দিন বলেন, রুহুল আমিন ও রেহেনা খুব অসহায় এক দম্পতি। তাদের কোনো ঘর নেই। এরা প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেলে গোটা দিঘরিয়া গ্রামবাসী খুশি হতো।
দিঘরিয়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত গ্রাম পুলিশ সুদেব কুমার বলেন, রুহুল আমিন ও রেহেনা দম্পতি এবং মোজাম্মেল হক ও মমেনা দম্পতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেতে নিয়ম অনুযায়ী ফরম পূরণ করে ইউএনও অফিসে জমা দিয়েছিলাম।
তাড়াশ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. নূর মামুন বলেন, ভুক্তভোগী রুহুল আমিন ও রেহেনা দম্পতি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাওয়ার জরিপ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবাউল করিম বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রুহুলের বাড়ি পরিদর্শন করা হয়েছে। রুহুল আমিন দম্পতিকে নগদ ২০ হাজার টাকা, ত্রানের টিন ও শীতবস্ত্র প্রদান করা হয়েছে। সরকারের জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পের আওতায় ঐ দম্পত্তিকে ঘর দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।