সুনামগঞ্জে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে হাওরের চার হাজার ৯০০ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ২৫ হাজার কৃষকের ৬৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। বাঁধ ভেঙে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলা ও অনিয়মকে দায়ী করছেন তারা।
গত ২ এপ্রিল দুপুরে তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়া হাওরের পাটলাই নদীর তীরের স্থানীয়ভাবে দেওয়া নজরখালী ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। এতে তলিয়ে গেছে ৬০ হেক্টর জমির কাঁচা ধান। ৫ এপ্রিল ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের কংস নদের তীরবর্তী ডুবাইল হাওর, একই দিন বিকালে শাল্লা উপজেলা সদরের দাড়াইন নদীর বাধ ভেঙে কইয়ার বন, পুটিপশি ও জোয়ারিয়া হাওরের ৬০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়।
৬ এপ্রিল রাতে দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের জারুলিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় টাংনির হাওর। ওই দিন রাত ১১টায় কালনী নদীর তীরে চাপতির হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, ২ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জেলার সাতটি উপজেলার ফসল ডুবে গেছে। এর মধ্যে সদরে ১০০ হেক্টর, দোয়ারাবাজারে ২০ হেক্টর, তাহিরপুরে ১৫০ হেক্টর, ধর্মপাশা ৫০০ হেক্টর, ছাতকে ৩০ হেক্টর, দিরাইয়ে ৩৬০০ হেক্টর ও শাল্লায় ২০০ হেক্টর জমির ধান উজানের ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে।
শাল্লা উপজেলার ঘুংগিয়ার গাও গ্রামের কৃষক মহাদেব সরকার বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলা ও অনিয়মের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বাঁধ সঠিকভাবে দেয়নি। তাই বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে ফসল ডুবে গেছে। এখন এতগুলো কৃষকের ক্ষতিপূরণ দেবে কে?
মোহন খল্লি গ্রামের আনন্দ সরকার বলেন, পিআইসিরা (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) দায়সারা কাজ করেছে। বাঁধের কাছ থেকে মাটি তুলে বাঁধ দিয়েছে। তাই ধসে যায়। কম্পেকশ না করায় বাঁধের নিচে লিক হয়ে হাওরে পানি ঢোকে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, গতবারের চেয়ে এবার বাঁধের কাজ অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে। তাই যথাসময়ে কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করতে অনিয়ম হয়েছে। উপকারভোগী কৃষদের কমিটিতে রাখা হয়নি। ঠিকাদারি প্রথার মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এখন পানি আসার পর বাঁধের কাজের গুরুত্ব বেড়েছে। অথচ আগে যথাযথভাবে বাঁধ নির্মাণ কাজ করলে হাওরবাসীর কষ্টের ফসল পানিতে ডুবে নষ্ট হতো না।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে। পিআইসির দুর্বল ফসল রক্ষা বাঁধের কারণে কৃষকদের ফসল হুমকির মুখে পড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কার্যালয়ের কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বেনজীর আলম।
সভায় হাওরের বোরো ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত জেলার সকল কৃষি কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার মাধ্যমে সহযোগিতা করা হবে। হাওরে ফসল যান্ত্রিক পদ্বতিতে কেটে ঘরে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় হারভেস্টার মেশিন সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেন বেনজীর আলম।
ফসলডুবির ঘটনার পর পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম সুনামগঞ্জে-২ দিনের সফরে আসেন। তিনি ৭ এপ্রিল ধর্মপাশা উপজেলার ডোবাইল হাওর এবং ৮ এপ্রিল দিরাই উপজেলার চাপতির হাওর পরিদর্শন করেন।
এ সময় উপমন্ত্রী বলেন, হাওরের ফসল রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ দেবে সরকার। সেজন্য কাজ চলছে। সুনামগঞ্জে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নদী খনন করা হভে। তিনি হাওরের ফসল রক্ষায় সুনামগঞ্জে কর্মরত পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করেন এবং হাওরের ফসল ওঠার আগে পর্যন্ত সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে সুনামগঞ্জে অফিস করার নির্দেশ প্রদান করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. ফজলুর রশিদ বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল রক্ষায় সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে। যেখানেই যা লাগে সেখানে তা সরবরাহ করা হচ্ছে। উপজেলাগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী জিও টেক্স, জিও ব্যাগ ও সিনথেটিক বস্তা দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হাওরের ফসল কৃষকের ঘরে ওঠার আগে পর্যন্ত সবাই বাঁধ টিকিয়ে রাখার কাজ করছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদ ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা দিন-রাত বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশে কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জের দুই লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমির বোরো ফসল রক্ষার জন্য এবার ৭২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে ৫৩৭ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁধে ১২২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। শুক্রবার রাত পর্যন্ত জেলার প্রায় দেড়শ’ ছোট-বড় হাওরের মধ্যে ১২টির ফসল উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে ডুবেছে। বেশিরভাগ হাওরে পানি ঢুকেছে বাঁধ ভেঙে।