ক্ষমতাচক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে বিগত সরকারের সময় ৬১১ জন বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকি দিয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুসন্ধানে কর ফাঁকিবাজের প্রথম হাজার জনের তালিকায় রয়েছে এই প্রভাবশালীদের নাম। তাদের কাছে সরকারের খেলাপি করের অঙ্ক প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছর এই সময়ে প্রথম এক হাজার খেলাপির কাছে পাওনা ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআর প্রতিবছরই প্রথম এক হাজার বড় কর ফাঁকিবাজের তালিকা প্রণয়ন করে খেলাপি অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে। এনবিআরের অনুসন্ধানে এই তালিকায় গত ছয় মাসে নতুন করে ৩১৭ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব জানা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এনবিআরকে দায়িত্বশীলভাবে দেশের শীর্ষ করখেলাপিদের তালিকা করার নির্দেশ দেয়। তদন্তে সিআইসি মোট পাঁচ বর্ষের তথ্য খতিয়ে দেখেছে। আগের চার করবর্ষসহ চলতি করবর্ষের জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা চূড়ান্ত করেছে এনবিআর। ১৫ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রাথমিক এই তালিকা এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছেন।
বিগত সরকারের সময় ক্ষমতাবলয়ের চারপাশে অবস্থান করা ৬১১ জনের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, দলীয় নেতা-কর্মীসহ অনেকেই।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনবিআর পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে কাজে আধুনিকতা এনেছে। সৎ করদাতাদের জন্য সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করতে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ চলছে। আগে কর ফাঁকি দিয়ে পার পাওয়া গেলেও বর্তমান এনবিআর একজন করখেলাপিকেও ছাড় দিচ্ছে না। এনবিআরের সব কয়টি শাখা সমান গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। করখেলাপি যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে এনবিআর জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।’
এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত আরেক টাস্কফোর্স কমিটি শুল্ক ফাঁকির তদন্ত করছে। ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকেও গঠিত টাস্কফোর্স ভ্যাট ফাঁকির তদন্ত করছে। সিআইসি তালিকা প্রণয়নে এই দুই টাস্কফোর্সের কাছ থেকেও তথ্য নিয়েছে।
কর ফাঁকি ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে এনবিআরের তিন টাস্কফোর্সের বাইরেও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এগুলো হলো প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), অর্থ, স্বরাষ্ট্র, ভূমি, আইন মন্ত্রণালয়, সিআইডি, বিভিন্ন বেসকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত আরও আটটি টাস্কফোর্স।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাচার করা অর্থের গন্তব্য, কর ফাঁকির পরিমাণ শনাক্ত এবং এসব অর্থ উদ্ধারে দেশে-বিদেশে ল’ ফার্ম নিয়োগ করা হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তাও নেওয়া হচ্ছে। তদন্তের প্রয়োজনে টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যরা বিদেশে গিয়েও তথ্য সংগ্রহ করছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র প্রেস সচিব শফিকুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘কর ফাঁকি দিয়ে অনেকেই অর্থ পাচার করেছে। তারা আবার দেশের মধ্যেও কর ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। সরকারের অর্থ আত্মসাৎ করে তারা এখন ভোগ-বিলাসে মত্ত। এসব দুর্নীতি তদন্তে মোট ১১টি কমিটি কাজ করছে। আশা করি কর ফাঁকির অর্থ উদ্ধার করে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। কর ফাঁকিতে বিগত সরকারের দোসররা জড়িত। এদের শাস্তি দেওয়া বর্তমান সরকারের দায়িত্ব।’
করখেলাপির তালিকায় শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের অনেক সদস্যই আছেন। প্রাথমিক তালিকায় আরও যাদের নাম আছে তারা হলেন শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাইম। শেখ হাসিনার পরিবারের আরও অনেক সদস্যর নামও এই তালিকায় এসেছে। তাদের মধ্যে আছেন শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, ওমর ফারুক চৌধুরী, শেখ ফজলে শামস পরশ, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ রুবেল, শেখ বেলাল, শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল ও শেখ তন্ময়, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, সুকান্ত আবদুল্লাহ ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহও। তালিকায় আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ওবায়দুল কাদের, শাজাহান খান, দীপু মনি ও তার ভাই, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, জুনায়েদ আহমেদ পলক ও তার স্ত্রী কনিকা, আমির হোসেন আমু, মেয়র আতিকুল ইসললাম, সাবেক সেনা কর্মকর্তা (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির মহাপরিচালক) মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ, এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
শীর্ষ ১০ করখেলাপির তালিকায় রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য এবং বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, ওরিয়ন গ্রুপ, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড (নগদ লিমিটেড), ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডসহ মোট ৩৭ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করখেলাপিরা নামে-বেনামে বাড়ি-ফ্ল্যাট-সম্পদ করেছে। অনেকে হাজার একর জমির মালিক হলেও তা রিটার্নে উল্লেখ করেননি। নামে-বেনামে ব্যবসা করেছেন। কিন্তু এসব ব্যবসার কথা রিটার্নে উল্লেখ নেই। অনেকে কোটি টাকা দামের গাড়ি চালালেও সেগুলো তাদের নামে নেই। দেশে-বিদেশে বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস করলেও তা রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি। এদের অনেকের বাড়িতেই বিভিন্ন সময়ে পুলিশের অভিযানে বহু মূল্যবান অলংকার পাওয়া গেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মিলিয়ে দেখা গেছে, সেসব অলংকারের কথা তারা রিটার্নে উল্লেখ করেননি। অলংকারের মালিকানার কথা এরই মধ্যে অনেকেই রিমান্ডে স্বীকার করেছেন। দেশ-বিদেশে বাণিজ্যিক স্থাপনা, হোটেল, রেস্তোরাঁ থাকলেও তার কথা কেউই সরকারি কোনো হিসাবে দেখাননি বলে এনবিআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বছরের পর বছর কর ফাঁকি দিয়েও প্রভাবশালীরা বিভিন্ন কৌশলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। মন্ত্রী-এমপি হলে তো কথাই নেই। এনবিআরের কোনো কর্মকর্তা পাওনা কর চাইলে কর পরিশোধের পরিবর্তে উল্টো তাকেই বদলি করা হয়েছে, হুমকিধমকি দেওয়া হয়েছে। এ রকম বহুবিধ নজির রয়েছে। এখন দিন পাল্টে গেছে। এনবিআরের কাজে গতি এসেছে। আশা করি এবার ফাঁকিবাজদের এনবিআর আটকাতে পারবে। এসব করখেলাপির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া সম্ভব হলে ভবিষ্যতে অন্যরা এপথে আর সাহস পাবে না।’
#খবরের কাগজ