সুলতান মনসুর-মোকাব্বিরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ফের টানাপোড়েন

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বাজছে ফের অনৈক্যের সুর। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত দুই সংসদ সদস্যের (এমপি) শপথ গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করায় সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতির। এর আগে একই ইস্যুতে এই জোটে দেখা দিয়েছিল টানাপোড়েন।

পরবর্তী সময়ে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এবার গণফোরাম ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার দুই এমপি শপথ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের এই দৃঢ় অবস্থানে ফ্রন্টের ঐক্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা শঙ্কা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র আটটি আসনে জয়লাভ করে। বিএনপির ছয়জন এমপি শপথ নেবেন না বলে দলীয় ফোরামে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও গণফোরাম থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি শপথ নেয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। তারা হলেন মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া-কমলগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও সিলেট-২ আসনে নির্বাচিত গণফোরাম নেতা মোকাব্বির খান।

ঢাকসু সাবেক ভিপি ও আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা সুলতান মনসুর মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। আর সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন গণফোরামের মোকাব্বির খান।সুলতান মনসুর ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করেছেন। আর সিলেট-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ায় গণফোরাম নেতা মোকাব্বির ঐক্যফ্রন্টের সমর্থন নিয়ে উদীয়মান সূর্য প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন।

ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী সুলতান মনসুর শপথ নেয়ার তথ্য তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জনগণের মতামত মূল্য দিতে শপথ নিচ্ছেন জানিয়ে সুলতান মনসুর বলেন, আমি বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিশ্রামে আছি। এই সময়টাতে আমার নির্বাচনী এলাকা জনগণ, যারা শত ঝুঁকি নিয়েও আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সারাদেশের অনেক নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের মতও আমি নিয়েছি। আমি একজন মানুষও পাইনি যিনি আমার শপথের বিপক্ষে। সবাই একবাক্যে বলেছেন আমার নির্বাচনী এলাকার জনরায়কে মূল্য দিয়ে শপথ নিতে। যেহেতু জনগণের জন্য রাজনীতি করি সেহেতু জনগণের মতামতকে মূল্য দিতে হবে।

‘আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষের যেমন আমার প্রতি প্রত্যাশা রয়েছে, তেমনি আমারও দায়বদ্ধতা রয়েছে তাদের মতের প্রতি’-যোগ করেন সুলতান মনসুর।

সিলেট-২ আসনে নির্বাচিত মোকাব্বির খানও শপথ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ নেয়ার বিষয়ে আমার নেতা ড. কামাল হোসেন সবসময় ইতিবাচক। আমরা দু’জনই (সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির) শপথ নেব।

তাদের শপথ গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করলেও ভিন্ন কথা বলছেন ফ্রন্টটির শীর্ষ নেতারা। তাদের মতে, শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত এখনও বহাল আছে।

শুধু তা-ই নয়, সোমবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও ঐক্যফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়কারী মোস্তাফা মহসীন মন্টু জানান, গণফোরাম তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো কোনো নির্বাচিত সংসদ সদস্য সংসদে যোগদান করছে- এ ধরনের সংবাদ অসত্য ও ভিত্তিহীন। সংসদে যোগ দেয়ার বিষয়ে গণফোরামে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

গণমাধ্যমকে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য না দেয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তথা জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য সুদৃঢ় ও অটুটু আছে।

ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের মতে, যে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, সেখানে শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়া মানেই আওয়ামী লীগের একতরফা এ নির্বাচনকে মেনে নেয়া। ফ্রন্টের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এ দু’জন শপথ নিলে ফ্রন্টের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

এমন পরিস্থিতিতে শিগগিরই ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক ডাকা হতে পারে। তবে ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন রয়েছেন দেশের বাইরে। তিনি ফেরার পরই ঐক্যফ্রন্টের পাশাপাশি গণফোরাম জরুরি বৈঠকে বসতে পারে। সেই বৈঠকেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সূত্র জানায়, গণফোরামের নীতিনির্ধারকরা শপথ নেয়ার পক্ষে নন। তাদের দু’জন শপথ নিচ্ছেন- গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশ হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তারা দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন। কামাল হোসেন বিষয়টি নিয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন। সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠান মোস্তাফা মহসীন মন্টু।

৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট শেষ হওয়ার পর ওই রাতেই বিএনপি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানায়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য দলগুলোও নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে। বিএনপির পক্ষ থেকে পরে জানানো হয়, তাদের নির্বাচিতরা কেউ শপথ নেবেন না।

কিন্তু গণফোরাম বিএনপির এমন সিদ্ধান্তে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও গোপনে তারা ভিন্ন মনোভাব দেখায়। ৫ জানুয়ারি রাজধানীর শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে গণফোরামের বর্ধিত সভা শেষে শপথের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট আলোচনার মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।

আমার ধারণা, সংসদে যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছি ঠিকই; কিন্তু আমাদের প্রার্থীরা বিরোধী দল থেকে জয়লাভ করেছেন। পরের দিন গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, ড. কামাল হোসেনের একটি বক্তব্য নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।

ড. কামাল হোসেন কোনোভাবেই বলেননি যে, গণফোরাম থেকে নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন। এছাড়া ঐক্যফ্রন্টে কোনো ‘অনৈক্য’ নেই।

মূলত তখন থেকেই বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি দূরত্ব শুরু হতে থাকে। এছাড়া জামায়াত প্রশ্নেও বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দূরত্ব বাড়ছে।

জানা গেছে, নির্ধারিত নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্য (এমপি) হিসেবে শপথ নিতে চান গণফোরামের দুই এমপি। এ প্রসঙ্গে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলেন, আমরা কখনও বলিনি শপথ নেব না। ড. কামাল হোসেনও বলেছেন, শপথ নেয়ার ব্যাপারে আমরা ইতিবাচক। আর এটাই আমাদের কথা।

এর বাইরে অন্যরা কে কী বলেছে, তা আমি জানি না। সময় তো আছে, তাড়াহুড়ার কিছু নেই। ৯০ দিনের মধ্যে শপথ নিলেই হবে। তিনি বলেন, জনগণ শত প্রতিকূলতায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের নির্বাচিত করেছে। আমি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছি। তবে সরাসরি বিএনপি থেকে নির্বাচন করিনি।

ধানের শীষ ঐক্যফ্রন্টের প্রতীক। যেহেতু নির্বাচন করব, তাই এই প্রতীক নিয়েছিলাম। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে আমাকে কেউ বের করে দেয়নি। আর আমি কোনো দলে যোগদানও করিনি। আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। গণফোরাম থেকে নির্বাচনে গেছি। কারণ গণফোরামে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মিল আছে।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি আমাকে ডাকে তাহলে চিন্তা করতে পারি। কারণ আমাকে তো আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলেন, বিএনপি তাদের সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে তো সবাই আলাদা দল। আমাদের সিদ্ধান্ত ‘অবশ্যই পজিটিভ’ হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে মনসুর বলেন, ঐক্যফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নিলেও সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের স্বাধীন চিন্তার অধিকার আছে। আমার এলাকার ভোটারদের কথা ভাবতে হবে। তারা কেন আমাকে নির্বাচিত করেছে। ধানের শীষ প্রতীকে আপনি নির্বাচিত হয়েছেন, বিএনপির সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নিলে আইনি কোনো সমস্যা হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এটা কোনো সমস্যা হবে না।

বিএনপি যদি সংসদে যেত, আর আমি যদি তাদের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দিতাম, সেক্ষেত্রে সমস্যা হতো। এখন যেহেতু বিএনপি সংসদে যাচ্ছে না। তাই আমার শপথে কোনো সমস্যা হবে না। আমি তো গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছি। আমার এলাকার জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে সংসদে কথা বলার জন্য। তাদের জন্য কাজ করতেই আমাকে সংসদে যেতে হবে।

সিলেট-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনার প্রার্থিতা হাইকোর্ট বাতিল করলে গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খানকে ‘উদীয়মান সূর্য’ প্রতীকে সমর্থন দেয় বিএনপি। মোকাব্বির খান বলেন, গণফোরাম সভাপতি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আছেন।

তিনি আসার পর আমাদের দলীয় ফোরামের বৈঠকে শপথের বিষয়ে আলোচনা হবে। তবে শপথ গ্রহণের বিষয়ে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। ফোরামের সিদ্ধান্তও ইতিবাচকই হবে বলে আশা করি। আমরা গণফোরাম ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। তবে বিএনপি কী করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। বিএনপির সিদ্ধান্ত তাদের নিজস্ব।

তবে তাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্তমান সংসদের ফ্রন্টের কোনো সংসদ সদস্য শপথ নেবে না এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।

শুধু ফ্রন্ট নয়, দল হিসেবে গণফোরামও শপথ নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তারা যদি শপথ নেয়, তাহলে সেটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। তিনি বলেন, এরা দু’জনই গণফোরাম থেকে নির্বাচিত। দু’জনই গণফোরামের নেতা।

এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াত ইস্যুতে ঐক্যফ্রন্ট শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের এক মন্তব্যে ঐক্যফ্রন্টে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ভারতের দুটি গণমাধ্যম ও এক সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেন, বিএনপি জামায়াতকে ধানের শীষে ভোট করার সুযোগ দেবে জানলে তিনি কখনোই বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করতেন না। তিনি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপিকে তাগিদ দেন। এরপর ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির অনৈক্য প্রকাশ্যে আসে। ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক বর্জন করে বিএনপি।সূত্র:যুগান্তর

173Shares

আরো পড়ুন