সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে রাজনীতির মাঠে সরব হয়ে উঠেছিল বিএনপি। গত ডিসেম্বরে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গতি এনেছিলেন দলটির নেতা-কর্মীরা। তবে চলতি বছর আন্দোলনের মাত্রা ও গতিতে ঘটেছে ছন্দপতন। ঝিমিয়ে পড়েছে রাজপথের কর্মসূচি।
যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের নিয়ে রমজান মাসেও কর্মসূচি দিয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বিএনপির এসব কর্মসূচিতে রাজনীতির মাঠে তেমন উত্তাপ ছড়াতে পারেনি। সরকারি দলও পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল। তবে ঈদের পর শরিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনা শুরু করলেও রাজপথে গড়ায়নি বিএনপির কোনো কর্মসূচি। ফলে আন্দোলন জমাতে ঘাম ঝরাচ্ছেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে এক বছরেরও কম সময়। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও তার যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের দাবি, বর্তমান সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবি ও ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করা হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। এর সঙ্গে মিল রেখে পৃথক পৃথক রূপরেখা দিয়েছে আন্দোলনের সঙ্গীরা। এসব দাবির পক্ষে জনমত গঠনে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্যরা। দাবিকে যৌক্তিক প্রমাণে রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে সরব হয়ে ওঠে বিএনপি ও তার আন্দোলনের সঙ্গীরা। রমজান মাসে ইফতার আয়োজনের মাধ্যমে ঘরোয়া রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়ায় বিএনপি। তবে রাজপথের কর্মসূচিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আন্দোলন কর্মসূচি।
বিএনপির নেতারা বলছেন, এই সরকারের অধীন আর কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তবে নির্বাচনের আগে দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচি কীভাবে এগোবে, আন্দোলনে কঠোর কর্মসূচিতে আসবে কি না- এসব নিয়ে দ্বিধায় আছেন দলের নেতারা। দফায় দফায় যুগপৎ আন্দোলন সঙ্গীদের সঙ্গে চলছে লিয়াজোঁ বৈঠক। এসব বৈঠকে আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছেন না বিএনপির নেতারা।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, সঙ্গীদের সঙ্গে লিয়াজোঁ বৈঠকে বিএনপি আন্দোলনের গতিপথ কোন দিকে নেয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করছে। এ নিয়ে শরিক দলগুলোর মত হলো, একটি অভিন্ন ও কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচির মাধ্যমে যুগপৎ আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে। কঠোর কর্মসূচি ছাড়া এ সরকারের পতনসহ বাকি দাবিগুলো আদায় করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের মত হলো, ঈদুল আজহার আগেই এই যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিকে কঠোর কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে জোর দিতে হবে।
আসন্ন ২১ জুন দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নিচ্ছে না বিএনপি। তবে বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিএনপির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও সিলেটে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনে অংশ নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের অক্টোবরে বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়। এসব নিয়ে আন্দোলন ও প্রতিবাদ করায় বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে সাধারণ মানুষের সমর্থন দৃশ্যমান হয়। এসব কর্মসূচিতে দলীয় নেতা-কর্মীরা হয়রানি ও হামলা-মামলার শিকার হন। ফলে এই আন্দোলন আরও গতি পায়। তবে সে আন্দোলন চলতি বছরের মার্চ (রমজান) মাসে এসে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। ঈদুল ফিতরের দুই সপ্তাহ পরও রাজনীতির ময়দানে বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান দৃশ্যমান নয়।
বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি ঝিমিয়ে কেন গেল- জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি আন্দোলনে আছে, আন্দোলনে ভবিষ্যতেও থাকবে। যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বিএনপির মতবিনিময় হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের পূর্ণ সমর্থন আছে। বরং বর্তমান সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।’
দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। বিএনপি নেতারা বলছেন, ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের পদযাত্রা, বিক্ষোভ সমাবেশসহ রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে বিএনপি নেতাদের বক্ত্যবের সুর একটাই- আগে এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তারপর তাদের ১০ দফা মেনে নিতে হবে। এর আগে এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না।
বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীন স্থানীয় সরকারের সহস্রাধিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এসব নির্বাচনের কোনোটিতেই বিএনপি দলগতভাবে অংশ নেয়নি। অবশ্য এর আগে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীন বিএনপি অংশ নেয়। তবে সেসব নির্বাচনে অংশ নিয়ে ইসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মামলা-হামলাসহ নানা রকম নিপীড়ন চালানো হচ্ছে সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে। দলের অনেক নেতা-কর্মী যেমন বিভিন্ন মামলায় আদালতে হাজির হচ্ছেন, কারাগারে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই বাড়িতে থাকতে পারছেন না। পাশাপাশি বিএনপির কর্মসূচির দিনে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলনের গতি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। মূলত সরকার আন্দোলনের শক্তিকে দুর্বল করতেই এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তার পরও বিএনপি ও যুগপৎ সঙ্গীরা আন্দোলনকে জোরদার করতে দফায় দফায় বৈঠক করে কৌশল নির্ধারণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যুগপৎ আন্দোলনে কোনো কঠোর কর্মসূচি আগামীতে আসছে কি না জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি এখনো মনে করছে শরিকদের নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচির বিষয়ে ঘোষণা দেয়ার মতো সময় এখনো হয়নি। কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার এখনো সময় আসেনি। সময় এলেই তা গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো হবে।’