এজাহারে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে ৮ পথশিশুর নামে ডাকাতির মামলা

রাজধানীতে থাকার কোনো জায়গা নেই, মাথার ওপর নেই ছাদ। দিন কাটে রাস্তায় বা ফুটপাতে, আর রাতে ঘুমাতে হয় পার্কের বেঞ্চে বা চট বিছিয়ে। এমন ৮ পথশিশুকে গুলিস্তান থেকে তুলে নিয়ে ডাকাতি প্রস্তুতির মামলা দিয়েছে পুলিশ। এসব শিশুর বয়স ১৪-১৫ বছর হলেও মামলার এজাহারে দেখানো হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘পথের ইশকুলে’র শিক্ষার্থী এই শিশুরা গ্রেপ্তারের পর তিন থেকে পাঁচ দিন নিখোঁজ ছিল। তাদের মধ্যে ৬ জন এক মাস ও দুজন ১০ দিন করে জেল খেটে মুক্তি পেয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, ঈদুল আজহার ছুটিতে ছিনতাইকারীর হাতে এক পুলিশ সদস্য নিহত ও এক সাংবাদিক আহত হন। এরপর রাজধানীজুড়ে ছিনতাইকারী-ডাকাতদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান ঘোষণা করে ডিএমপি। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগে প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে পরদিন ভোর ৬টা পর্যন্ত এ বিশেষ অভিযান চালানো হয়। ডিএমপির একজন যুগ্ম কমিশনারের (অপরাধ) তত্ত্বাবধানে অভিযান তদারক করেন উপকমিশনার পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। জুলাইয়ের প্রথম ১৪ দিনে ৬৭৯ ও বাকি ১৭ দিনে গ্রেপ্তার করা হয় তিন শতাধিক ছিনতাইকারীকে।

‘পথের ইশকুল’ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ২ জুলাই দুপুরে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ভেতর থেকে সাব্বির ও আবদুল্লাহ নামে দুই পথশিশুকে সাদা পোশাকে আটক করে বংশাল থানা পুলিশ। ৪ জুলাই সন্ধ্যায় ওই স্টেডিয়ামের ৩ নম্বর গেট থেকে নওশাদকে আটক করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। ৫ জুলাই সন্ধ্যায় গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের সামনে থেকে মুসাকে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ। ৬ জুলাই সকালে একই জায়গা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে ইয়াসিন, আকাশ ও রহিম নামে তিন পথশিশুকে। ১২ জুলাই রাতে গুলিস্তান থেকে ভুট্টো নামে এক পথশিশুকে আটক করে পল্টন থানা পুলিশ। তাদের মধ্যে ইয়াছিন, ভুট্টো ও সাব্বির ২০১৭ সাল থেকে পথের ইশকুলের শিক্ষার্থী। আকাশ ২০১৯, নওশাদ ২০২০, মুছা ২০২২ সাল থেকে পড়ছে ওই স্কুলে। আবদুল্লাহ ও রহিম চলতি বছর থেকে পথের ইশকুলে পড়ছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ৬ জুলাই ঢাকা মহানগর এলাকায় চোরাই গাড়ি ও অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার এবং সংঘবদ্ধ অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান পরিচালনাকালে জানা যায়, ওসমানী উদ্যানের সামনে ফুটপাতের ওপর ৭-৮ জনের একটি দুষ্কৃতকারী দল দেশীয় অস্ত্রসহ ডাকাতির জন্য অবস্থান করছে। চাপাতি, ছুরিসহ সেখান থেকে ৫ জনকে আটকের কথা বলা হয়েছে এজাহারে। মামলায় রিয়াজ, সাব্বির হোসেন, ইয়াছিন খান, আকাশ ও রহিমকে আসামি করা হয়েছে। তাদের বয়স দেখানো হয়েছে ১৮ থেকে ২০। বাকি চারজনের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে আরও দুটি মামলা করা হয়েছে যাত্রাবাড়ী ও বংশাল থানায়।

এ বিষয়ে শাহবাগ থানায় করা মামলার বাদী ডিএমপির গোয়েন্দা রমনা বিভাগের এসআই লক্ষ্মী রানী পণ্ডিত কালবেলাকে বলেন, আমি আগের দায়িত্বে নেই, বদলি করা হয়েছে। আমাকে এই মামলার বাদী করার কথা নয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাতে পারব।

পথের ইশকুলের পরিচালক সাকির ইবরাহিম মাটি বলেন, বিশেষ অভিযানের নামে ২ থেকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে পুলিশ আমাদের ৮ শিশুকে গ্রেপ্তার করে এজাহারে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়েছে। তাদের বেআইনিভাবে ২-৪ দিন আটকে রেখে পরে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার লঙ্ঘন। এজাহারে একই মিথ্যা বর্ণনা দিয়ে শিশুদের বিভিন্ন থানায় মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।

তিনি বলেন, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী সরকারি এবং বেসরকারি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান, আদালত, প্রশাসন বা আইন প্রণয়নকারী ব্যক্তি যেই হোন না কেন, শিশু বিষয়ে যে কোনো ধরনের কার্যক্রমে শিশুর স্বার্থই হবে প্রথম ও প্রধান বিবেচনার বিষয়। কিন্তু বাস্তবে প্রতিনিয়ত সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এবং মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে এই শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ ও সামাজিকীকরণ ব্যাহত হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তারেক রহমান বলেন, গ্রেপ্তার শিশুদের বেশিরভাগের বয়স ১৪-১৫ বছর। তবে তাদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর দেখানো হয়েছে। গুলিস্তান থেকে আটকের তিন-চার দিন পর্যন্ত তাদের খোঁজ ছিল না। কোন থানায় আটক রাখা হয়েছে তাও জানানো হয়নি। আটকের ৩ থেকে ৭ দিন পর তাদের আদালতে উপস্থাপন করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, যা আইনের লঙ্ঘন। তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা দেওয়া হয়েছে, প্রতিটি মামলার ধারা একই রকম। ডাকাতির জন্য সমবেত হওয়া ও প্রস্তুতি; মামলার এজাহারগুলো কপি পেস্ট করা।

তিনি বলেন, আটজনের জামিনের জন্য চেষ্টা করলে জানতে পারি, পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে বলা হয়েছে জামিন না দিতে। ছয়জনের কাছ থেকে চাকু উদ্ধার দেখানোয় তাদের জামিন হয়েছে এক মাস পরে। বাকি দুজনের কাছ থেকে কিছু উদ্ধার না দেখানোয় ১০ দিন পর তারা জামিন পেয়েছে।

#কালবেলা

আরো পড়ুন