নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নার্গিস আক্তারের সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন ভুক্তভোগীরা। যত অনিয়ম ও দুর্নীতি এ কর্মকর্তাকে যেন চৌম্বকীয় আবেশে জড়িয়ে ধরেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগে জানা যায়, মহিলা সংস্থার সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতা আত্মসাৎ, নিয়মিত অফিসে না আসা, প্রশিক্ষণে ভুয়া নাম দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, উৎকোচ ছাড়া সরকারি অনুদানের চেক না দেয়া, নতুন সমিতির নিবন্ধন করতে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ, আসবাবপত্র ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম, সরকারি বিভিন্ন দিবসের কর্মসূচি পালন না করে দীর্ঘদিন ধরে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছেন এ কর্মকর্তা।
ভুক্তভোগীরা জানান, এসব অনিয়মের অভিযোগ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানো হলেও অজ্ঞাত কারণে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। সরকারি বিধি অনুযায়ী এক অফিসে তিন বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করার সুযোগ না থাকলেও এ কর্মকর্তা একই অফিসে সাত বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর দিচ্ছে না।
তারা আরো জানান, এসব দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাইলে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন এবং হয়রানির ভয় দেখান তিনি।
নার্গিস আক্তারের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির ফিরিস্তি উল্লেখ করে নরসিংদীর ডিসি এবং বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ১২ ভুক্তভোগী।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নার্গিস আক্তার ২০১৩ সালে মনোহরদী উপজেলায় যোগদান করেন। এরপর থেকেই তার নানা অনিয়ম ও অব্যস্থাপনার কারণে কাঙিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সেবা প্রত্যাশীরা। তাছাড়া একই অফিসের অফিস সহায়ক (পিয়ন) রিয়াজ উদ্দিন প্রায় দুই যুগ ধরে এই অফিসে কাজ করে যাচ্ছেন। এ কর্মকর্তা এবং পিয়ন রিয়াজ মিলে এই অফিসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। বিভিন্ন অনুদান এবং ভাতা তুলতে গেলে পিয়ন রিয়াজ উদ্দিনকেও দিতে হয় উৎকোচ।
শাহনাজ পারভিন মিতু নামে এক ভুক্তভোগী জানান, তিনমাস সেলাই প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে ছয় হাজার ৩০০ টাকা ভাতা দেয়ার কথা। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রায় অর্ধেক টাকা জোর করে রেখে দিয়েছেন নার্গিস আক্তার। টাকা কম দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি সবাইকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং হয়রানির ভয় দেখান। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি ইউএনওকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
তাছাড়া একই প্রশিক্ষণে রুমা, নাছিমা এবং তাছলিমা নামে তিনজন নারীর ভুয়া নাম বসিয়ে নিজেই এসব ভাতা তুলেছেন এ কর্মকর্তা। প্রতি ব্যাচেই ৫-৭ জনের ভুয়া নাম বসিয়ে নিয়মিতই অর্থ আত্মসাৎ করেন বলে জানিয়েছেন এ ভুক্তভোগী।
তিনি আরো জানান, সেলাই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে আসা নারীদেরকে কাঁথা সেলাই করতে বাধ্য করেন নার্গিস আক্তার। পরে এসব কাঁথা ঢাকায় নিয়ে ভালো দামে তিনি বিক্রি টাকা হাতিয়ে নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিলা সমিতির এক নেত্রী জানান, প্রতি বছর মহিলা সমিতির নামে সরকার অনুদান দিয়ে থাকে। এসব অনুদানের চেক উঠাতে গেলে ৪-৫ হাজার টাকা দিতে হয় নার্গিস আক্তারকে। টাকা কম দিলে সদস্যদেরকে গালাগাল করেন। তাছাড়া নতুন সমিতির নিবন্ধন করতে চাইলে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয় এ কর্মকর্তাকে। অন্যথায় কাগজপত্র জমা নেন না।
কিশোর কিশোরী ক্লাবের এক জেন্ডার প্রমোটার জানান, উপজেলায় ১৩টি কিশোর কিশোরী ক্লাব রয়েছে। এসব ক্লাবের আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য দুইলাখ ৭১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। সে হিসেবে ভাগ করলে প্রত্যেক ক্লাবে ২০ হাজার টাকার অধিক আসে। অথচ প্রতিটি কেন্দ্রে একটি ফাইল কেবিনেট, একটি ওয়ালক্লথ এবং দুটি প্লাস্টিকের চেয়ার দেয়া হয়েছে। যার আনুমানিক সর্বোচ্চ মূল্য হতে পারে পাঁচ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে তিনি মাত্র ৬০-৭০ হাজার টাকার মালামাল ক্রয় করে বাকি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
তাছাড়া গত শোক দিবসের কর্মসূচি পালনের জন্য সরকারিভাবে প্রত্যেক ক্লাবে এক হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়। ওইদিন কর্মসূচি পালন না করে এসব টাকাও আত্মসাৎ করেছেন তিনি। শোক দিবসের কর্মসূচি পালন না করার কারণ জানতে চাইলে এ দিবস পালনের প্রয়োজন নেই বলে তিনি।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নার্গিস আক্তার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র। আমি কোনো অনিয়ম এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না।
নরসিংদী জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উপ-পরিচালক সেলিনা আক্তার বলেন, মনোহরদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাছাড়া এরইমধ্যে ওই অফিসের একজন অফিস সহকারী এবং একজন অফিস সহায়ককে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।