উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি চিকিৎসকরাও বিদেশের হাসপাতালে ছুটছেন। কেউ যাচ্ছেন নিজের চিকিৎসার জন্য। কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাচ্ছেন। উন্নত চিকিৎসার কারণ দেখিয়ে গত জানুয়ারি থেকে এ যাবৎ প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক চিকিৎসকের নামে সরকারি আদেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যাদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও রয়েছেন। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের রয়েছে তিন শতাধিক চিকিৎসক। আর বাকিরা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অধীনে চাকুরীরত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জটিল ও দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসকরা বিদেশি হাসপাতালের শরনাপন্ন হয়ে থাকেন। এসব রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশেই এখন হচ্ছে।
বাংলাদেশে সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। তারপরও কিছু চিকিৎসক দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপর ওপর আস্থা না থাকায় বিদেশে যাচ্ছে। বিদেশে চিকিৎসা বাবদ প্রচুর পরিমাণে ডলার খরচ হচ্ছে। যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার একটি কারণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা ট্রিটমেন্টের জন্য সিঙ্গাপুর যান। সেখানে চিকিৎসার এক পর্যায়ে তার অবস্থা অবনতির দিকে যায়। তিনি যে ট্রিটমেন্টের উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুরে গিয়েছেন একই ট্রিটমেন্ট বাংলাদেশের বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছে। এধরণের কর্মকাণ্ডে দেশের মানুষের কাছে চিকিৎসা খাত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। বেশিরভাগ চিকিৎসক নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতে গেছেন চিকিৎসার জন্য।
গত ৮ মাসে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের প্রায় ২৪০ জন চিকিৎসক নিজের কিংবা পরিবারের সদস্যের চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ উন্নত চিকিৎসার কথা উল্লেখ করে ছুটির আবেদন করেছেন। এছাড়া সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দুবাই, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতে চিকিৎসার পরিবারসহ জন্য ভ্রমণ করেছেন চিকিৎসকরা। বিদেশগামী চিকিৎসকদের মধ্যে একটি বড় অংশ গেছেন বন্ধ্যাত্ব রোগের চিকিৎসায়। এই উদ্দেশ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর নামে একই সঙ্গে সরকারি আদেশ জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে টানা দুইবছর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাত্রা সীমিত ছিল। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। চিকিৎসকের বিদেশমুখীতা কমাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সবশেষ মেডিকেল বোর্ডের সনদ দাখিলের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৪ জুলাই পরিপত্র জারি করে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। ‘বিসিএস(স্বাস্থ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তাগণের বহিঃবাংলাদেশে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য মেডিকেল বোর্ডের সনদ দাখিল’ বিষয়ক ওই পরিপত্রে বলা হয়, বিসিএস(স্বাস্থ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তাগণের বহি:বাংলাদেশে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য প্রায়শঃই আবেদন পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু আবেদনের সাথে দেশে প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিস কর্তৃক গঠিত মেডিকেল বোর্ডের কোন সুপারিশ থাকে না। যার প্রেক্ষিতে কর্মকর্তাগণের বহি:বাংলাদেশে চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় না। এ প্রেক্ষিতে কর্মকর্তাগণের বহিঃবাংলাদেশে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য ছুটি মঞ্জুরের ক্ষেত্রে দেশে প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিস কর্তৃক গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ দাখিল করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারির পরও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশযাত্রা কমেনি সরকারি চিকিৎসকদের। জুলাই-আগস্ট মাসেই সর্বাধিক সংখ্যক চিকিৎসক তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। সরকারি চিকিৎসকদের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা দেশের স্বাস্থ্য খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনও সুষম স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এদেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার মান নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে চিকিৎসকদের ব্যবহার নিয়ে। দেশের উপজেলার হাসপাতালগুলোর মান বাড়ালে মানুষের বিদেশ নির্ভরতা কমতো। একটা রেফারেল সিস্টেম থাকলে গ্রাম থেকে সঠিক প্রক্রিয়ায় বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারতো। চিকিৎসা শিক্ষার মানও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তার মতে চিকিৎসকদের ডিগ্রিতে কমিউনিকেশন ও বিহাভেরিয়াল সায়েন্স আলাদাভাবে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত।