বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোয় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে স্থায়ী জামিন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ায় দলের নেতাদের মধ্যে হতাশাও বিরাজ করছে। দলের সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়ার বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার শর্তারোপ শিথিল করারও দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে ‘দায়’ সরকারকেই নিতে হবে বলেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমরা আশা করেছিলাম, সরকার তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেবে। কিন্তু সরকার আবারও তাকে বিদেশে না যাওয়ার শর্তারোপ করেছে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সরকার উন্নত চিকিৎসার বাইরে রাখায় তারা হতাশ।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার খালেদা জিয়াকে জামিন দিয়েছে বলা যাবে না, কার্যত তিনি গৃহ-অন্তরীণ। এখন তাকে মুক্ত করাই তাদের এক নম্বর কাজ। খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের নেত্রী, দীর্ঘকাল তিনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাকে বের করে আনাটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়। মুক্তির ক্ষেত্রে আগে যেসব শর্ত ছিল সেগুলো অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ এ সময়ে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। নিজ বাসায় থেকে তাকে চিকিৎসা নিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা কারণে বেশ কিছুদিন ধরে খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিন ও বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন দলের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় হবেন বলে আশা করেছিলেন তারা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগের বিষয়টিও তাদের আশাবাদী করেছিল।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, খালেদা জিয়া বিদেশে গিয়ে তার নানামুখী রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করতে পারেন। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিদেশিদের সঙ্গেও বৈঠক করতে পারেন বলে মনে করছেন তারা। এমন নানা হিসাব-নিকাশ কষেই খালেদা জিয়াকে বিদেশে না যাওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, কারাগারের প্যানেল চিকিৎসকরাও খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সে কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিকেরও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসা নেওয়ার সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। অথচ উন্নত চিকিৎসা নিতে মন্ত্রী-এমপিরা অহরহ বিদেশে যাচ্ছেন। খালেদা জিয়ার ব্যাপারে কেন বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে? এক দেশে দুই ধরনের আইন কেন?
খালেদা জিয়ার চিকিৎসক টিমের সদস্য ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের আধুনিক চিকিৎসার জন্য আধুনিক সেন্টার প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও সত্য, যা বাংলাদেশের কোনো হাসপাতালে নেই। এ জন্য জরুরি প্রয়োজন হলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে বিদেশে পাঠাতে হয়। খালেদা জিয়া বয়সজনিত কারণে নানারোগে আক্রান্ত। তারও মাল্টিপল চিকিৎসা নেওয়ার মতো হাসপাতাল প্রয়োজন। তা ছাড়া খালেদা জিয়া আগে থেকেই লন্ডনে নিয়মিত নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান, সরকারের নির্বাহী আদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্থায়ী জামিন ও উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে যেতে কোনো আইনগত সমস্যা নেই। তারপরও সরকার নানা অজুহাত দেখিয়ে উন্নত চিকিৎসা থেকে তাকে বঞ্চিত রাখছে।
সূত্র জানায়, জামিনের আবেদনকারী খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, বড় বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও ছয় মাসের মেয়াদ বৃদ্ধিতে সন্তুষ্ট নন। তারা আশা করেছিলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খালেদা জিয়াকে স্থায়ী জামিন দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ায় তারাও হতাশ।
ছয় মাসের জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে আসায় গত ২৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে স্থায়ী মুক্তি চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল। বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর বিষয়েও তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়। এর আগে সরকারের নির্বাহী আদেশে গত ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর মেয়াদ ২৪ সেপ্টেম্বর শেষ হবে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি মামলা বিচারের পর্যায়ে আছে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা ভোগ করছেন খালেদা জিয়া। দুই মামলায় তার ১৭ বছরের সাজা হয়েছে। ৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস এবং চোখে সমস্যা ও আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। বর্তমানে গুলশানে ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় অবস্থান করছেন তিনি।