টেবিলের দুইপাশে মুখোমুখি বসা। আমি আর ম্যাডাম। পেশেন্ট আসে আর যায়। প্রতিদিন কম করে হলেও একশো পেশেন্ট হয়। আবার কখনো কখনো দেড়শো ছাড়ায়। হাজার মানুষের পথচলায় মুখর এই হসপিটাল। এখানে কেউ দুঃখ সারাতে আসে, কেউ আসে ঔষধের বিনিময়ে সুখ কিনতে।
আউটডোরের প্রতিটি ডক্টর কক্ষের সামনে লম্বা লাইন থাকে পেশেন্টের। সকাল থেকে সরকারি টিকেট কেটে আগেভাগে লাইনে দাঁড়ানোর চেষ্টা সবার। যে যত আগে দাঁড়াতে পারবে সে তত আগে বাড়ি ফিরতে পারবে। আসলে মূলত পৃথিবীর এমন কোথাও নেই যেখানে প্রতিযোগিতা ব্যতিরেকে কেউ টিকতে পেরেছে।
যেমন ধরুন, আপনি জন্ম নিলেন। বেঁচে আছেন। এগুলোও প্রতিযোগিতার ফলস্বরূপ। ব্যাপারটা ক্লিয়ার করি। জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হয় একজন নারী ও একজন পুরুষের একটি সফলতম ফিজিক্যাল সেক্স অর্থাৎ শারীরিক মিলনে পরস্পরের শুক্রাণু-ডিম্বাণু মিলিত হওয়ার পর জাইগোট-ভ্রূণ-তারপর আপনার জন্ম।
এই যে শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলন, এটাও একটি প্রতিযোগিতা। একজন পুরুষের লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু নির্গত হয় কিন্তু ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হতে পারে স্রেফ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা শুক্রাণুটি। তারপর জন্ম নিলো একটি ভ্রূণ। এই ভ্রূণের মায়ের পেটে বসে ফিটাস তারপর সফলভাবে জন্ম নেয়া। জন্মের পর যুদ্ধ করতে হয়েছে অগণিত জীবানুর সাথে। হেরে গেলে মৃত্যু। জিতে গেলে দীর্ঘায়ু।
এভাবে প্রতিযোগী হয়ে জিততে জিততে একজন মানুষ কিছুটা সময় বেঁচে থাকতে চায় ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে। আবার সে যখন অসুস্থতা বোধ করে তখন চায় সুস্থ হতে। সুস্থ হতে হলেও ফাইট করতে হবে, লড়তে হবে শরীরে বাসা বাঁধা জীবানুর সাথে। এর জন্য চাই মেডিসিন। মেডিসিন সাজেস্ট করবার জন্য ডক্টর আর হসপিটাল।
তো সচেতন বোধসম্পন্ন মানুষজন আজকাল প্রচুর ভিড় জমায়। অপেক্ষা করে সামনের জনের পর তার সিরিয়ালের। অপেক্ষা শেষ হলে ঢুকে পড়ে ডক্টর রুমে। মুখোমুখি হয় ডক্টরের। এখানেও হেনস্তা। গাইনি রোগ। যদি পুরুষ ডক্টর হয় মহিলারা চলে যান। পুরুষের কাছে তাদের গোপন রোগের বৃত্তান্ত বলা লজ্জাকর।
যাই হোক, এই পরিস্থিতিতে তাদের পড়তে হচ্ছে না। ভিতরে মহিলা ডক্টর গাইনি বিশেষজ্ঞ। তবুও কেউ কেউ ইতস্তত বোধ করে। সব কিছু খুলে বলেন না। কেমন যেন একটা ব্যাপার!
একজন বয়স্ক মহিলা। বয়স চল্লিশ কী পঁয়তাল্লিশ। টিকিটে লেখা ২৫ বছর। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, ছোট বাচ্চার বয়স কত?
মহিলা উত্তর করলেন, কুঁড়ি বছর।
আর বড় বাচ্চার?
পঁচিশ কী ত্রিশ।
তাহলে আপনার কি পঁচিশ বছর? আপনি এদের চেয়েও ছোট? (হাত দিয়ে তার সামনে বসা আমাদের দেখিয়ে)
বয়স বলতে পারবো না। মনে নাই।
উনি সম্ভবত লজ্জা পেয়েছেন। রোগীদের এই একটা দোষ। বয়স বলতে চায় না। আর বলবে না ভালো কথা। আমরা বুঝে নেব কিন্তু তা না বলবে অর্ধেক।
তো,কী সমস্যা? খুলে বলেন।
এগো সামনে কমু না। শরম লজ্জার কথা।
আমিও যা, এরাও তা। আমি শুনতে পারলে এরাও শুনতে পারবে। আপনি বলুন। ওরাও শুনবে।
আমার মিনস বন্ধ। তিনমাস। পেট ভারী ভারী লাগে।
এটা তার কাছে লজ্জার। ব্যাপার না। ম্যাডাম আল্ট্রাসোনোগ্রাম আর ইউরিন টেস্ট দিলেন। রিপোর্ট নিয়ে আসলেন। উনি কনসিভ করেছেন। এবার তো আরো সর্বনাশ। এটা ডক্টর একা জানতো, ক্ষতি ছিল না। কিন্তু আমরাও জেনে গেলাম। শরম লজ্জার কথা।
আপনি কনসিভ করেছেন। চারমাস বাচ্চার বয়স।
স্যার আমি বাচ্চা রাহুম না। ওষুধ দেন। নষ্ট কইরা ফালামু।
আমি বাচ্চা নষ্টের ঔষধের নাম জানি না। বাচ্চা আপনাকে রাখতে হবে। নষ্ট করবেন কেন? আর কোনো পদ্ধতি নেন না কেন? মগের মুল্লুক এটা? বাচ্চা নষ্ট করবেন?
পদ্ধতি নিতে পারি না। আমার সমস্যা আছে।
তো আপনার স্বামী নেয় না কেন? উনি তো নিতে পারে।
উনি আগে বেলুন (কনডম) ব্যবহার করতো। এখন করে না। আরাম পায় না।
ম্যাডাম এর দিকে খেয়াল করে দেখলাম উনি রাগে ক্ষ্যাপতেছেন কিন্তু কিছু বলছেন না। এটা সত্য কথা যে, পরিবার পরিকল্পনার অনেক পদ্ধতি চালু আছে। কিন্তু অনেকগুলোতেই মেয়েদের শারীরিক ক্ষতি হয়। যেমন – পিল,ইনজেকশন, কপাটিকা। কিন্তু ছেলেদের জন্য যা আছে তাতে ছেলেদের কোনো শারীরিক ক্ষতি হয় না। তবুও ছেলেরা সেটা ব্যবহার করতে চায় না। কারণ দর্শায় তারা ফিলিং কম পায়। কেউ কেউ বলেও পর্দা কইরা মজা নাই বা গ্লাভস পরে টাচ করার মতো। ব্যাপারটা আসলে ভুল ধারণা।
কনডম শারীরিক মিলনে কোনোরূপ ক্ষতি বা বাধা বা আনন্দ লঙ্ঘন করে না। বরং মেয়েদের জন্য ভালো। তবে কিছুকিছু ক্ষেত্রে রাপচার অর্থাৎ কনডম ফেটে যেতে পারে। এটা অনিরাপদ। তবে বিবাহিত জীবনে আপনি একটি সহজ প্রাকৃতিক হিসেব অনুযায়ী সেক্স করলে বাচ্চা ধারণ থেকে বিরত থাকতে পারেন। সেটা হলো সেইফ পিরিয়ড।
আপনার যদি প্রতিমাসে নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে পিরিয়ড হয় তবে এই পদ্ধতি আপনার জন্য সহায়ক। যেদিন থেকে পিরিয়ড হবে সেই প্রথমদিনকে এক তারিখ ধরে মোট পরবর্তী দশদিন সেইফ পিরিয়ড। অর্থাৎ এই দশদিন সেক্স করলে বাচ্চাধারণ করবে না। তারমানে পিরিয়ডের সাতদিন বাদ দিলে তিনদিন আপনার জন্য সেইফ পিরিয়ড।
তার পরবর্তী দশদিন রেড এলার্ড মার্ক বিপজ্জনক দিন। এই দশদিনে সেক্স করলে আপনি অবশ্যই কনসিভ করবেন। তাই এসময় সেক্স করতে চাইলে সাময়িক কোনো পদ্ধতি যেমন- কনডম, এমারজেন্সি পিল ব্যবহার করতে পারেন। আবার এরপরের অর্থাৎ শেষ দশদিন আবার সেইফ পিরিয়ড। এসময়ে আপনি সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন।
#লুনা আহমেদ