শেরপুর-১ আসনের ছয়বারের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) সাবেক দুই বারের হুইপ মো. আতিউর রহমান আতিক। আতিউর রহমান আতিক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন শেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য, শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দীর্ঘ এই সময়ে জেলা উপজেলা রাজনীতিতে ছিল একক আধিপত্য। আর এই একক আধিপত্য ধরে রাখতে নিজের ভাই, ভাতিজা, বড় মেয়ে এবং ঘনিষ্ট বন্ধুদের দলীয় পদ দেওয়ার পাশাপাশি বানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিও।
প্রভাব খাটিয়ে নিজের ছোট ভাইকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, স্ত্রী শামছুন্নাহার শান্তা শেরপুর শহরের চন্দ্রকান্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা, বড় মেয়ে শারমিন রহমান অমিকে পরিবার পরিকল্পনা অফিসের কর্মকর্তার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করাতেন টেন্ডার সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাণিজ্য।
শুধু তাই নয় উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করতে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচিতে অমিকে রাখতেন নিজের সঙ্গে। আর ভাতিজা আশিককে দিয়ে করিয়েছেন নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখল। এখানেই শেষ নয়, ক্ষমতা অপব্যবহারের পাশাপাশি সম্পদ ও নামের কাঙাল ছিলেন আতিউর রহমান আতিক। নিজের নামে এবং স্ত্রী সন্তানদের নামে বাড়ি, গাড়ি, শেরপুর ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে জমি ক্রয়, অ্যাপার্টমেন্ট, মার্কেট, বাগানবাড়িসহ শতশত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন তিনি।
শেরপুর তিনআনি বাজারে বিলাসবহুল বাড়ি, গ্রামে ৩০ একর জমিতে বাগানবাড়ি, ঢাকার বসুন্ধরা ও বনশ্রীতে পাঁচ প্লট, রাজউকের প্লট, উত্তরা, ধানমন্ডি ও গুলশানে তিনটি ফ্ল্যাট। সরকারি খাসজমি দলীয় নামে নিয়ে তা নিজের কাজে ব্যবহার করছেন। শেরপুরে বিভিন্ন বাণিজ্যক ভবন নির্মাণ করে তিনি সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, আয়কর অফিসসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তার ভবনে ভাড়া নিতে বাধ্য করেছেন। এছাড়া শেরপুর সদর উপজেলায় দুরুঙ্গি বিলে ৬০ একর ফসলি জমি এবং তেঁতুলিয়া এলাকায় ৫ একর জমি রয়েছে তার। অন্যদিকে ঢাকার লালমাটিয়ায় তার একটি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট এবং ঢাকার নিকুঞ্জ ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা যায়।
এ ছাড়া নিজের স্ত্রী ও মেয়েদের নামে শতভরি স্বর্ণালঙ্কার ও বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এফডিআর রয়েছে। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় (২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর) দাখিল করা হলফনামায় বাস্তবতার সঙ্গে রয়েছে আকাশ-জমিন ফারাক।
হলফনামায় বাৎসরিক আয় হিসাবে কৃষিখাত থেকে ১১ লাখ ৪ হাজার টাকা, চাকরি সম্মানীভাতা হিসেবে ১১ লাখ ৪ হাজার টাকা এবং মাছ চাষ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করেন বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া অস্থাবর সম্পদ হিসাবে নিজের নামে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা ও স্ত্রীর নামে ১৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন সময় তার স্ত্রী ১০০ ভরি স্বর্ণলঙ্কার উপহার পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। স্থাবর সম্পদ হিসেবে নিজের নামে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ২১ লাখ ৯ হাজার টাকার কথা উল্লেখ করেছেন।
শুধুমাত্র জমি কেনার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আতিউর রহমান আতিক নিজের ক্ষমতা এবং কর্মকর্তাদের বদলির ভয় দেখিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ও ভূমি অফিসকে দিয়ে শেরপুর সদরের বিভিন্ন এলাকায় ১৯৯৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে কেনা আমমোক্তারনামার মাধ্যমে গ্রহণ, হেবাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২১টি দলিল সম্পাদিত করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে এসব জমি কিনেছেন তিনি। ওই সম্পদের বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক শত কোটি টাকা। ৮৮৩৯ নম্বর দলিলে বারঘরিয়া মৌজায় আর ও আর ৬৫ ও বিআরএস ৮৭ খতিয়ানের আর ও আর ৯৪ এবং বিআরএস ১৬৪নং দাগের ১২৭ কাতে ৩৫ শতাংশ জমি লিখে দেন আব্দুল বারিক ও মৃত নছিমদ্দিন। এছাড়াও ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ৮৮৩৯ নম্বর দলিলে বারঘরিয়া মৌজায় আর ও আর ৬৫ ও বিআরএস ৮৭ খতিয়ানের আর ও আর ৯৪ এবং বিআরএস ১৬৪নং দাগের ১২৭ কাতে ৩৫ শতাংশ জমি লিখে দেন আব্দুল বারিক ও মৃত নছিমদ্দিন। ৮৯১০ নম্বর দলিলে আন্দারিয়া এলাকার কবিরপুর আন্দারিয়া মৌজার আর ও আর ১২৬৫ ও বিআরএস ১২৩০ খতিয়ানের আর ও আর ২৯ এবং বিআরএস ২ দাগের ২২ কাতে ১০ দশমিক শতক এবং আর ও আর ২৯ এবং বিআরএস ৩ দাগের ২৯ কাতে ১০ শতক মোট ২০ শতক জমি এমপির নামে লিখে দেন আবুল হোসেন ও আব্দুল সেখ।
এ ছাড়া আতিক ডজনখানেক বাণিজ্যিক স্কুল-কলেজ সরকারি অর্থায়নে ভবন নির্মাণ করে সেগুলো নামকরণ করেছেন নিজের নামে। তিনি নিজের নামে আতিউর রহমান মডেল কলেজ, আতিউর রহমান মডেল গার্লস স্কুল, আতিউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়, আতিউর রহমান আলিম মাদ্রাসা, আতিউর রহমান হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল এবং আতিক নগরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন নিজ নামে।
ভুক্তভোগী ডা. রেজুয়ানুর রহমান বকুল বলেন, ২০১৩ সালে শেরপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও আলহাজ আব্দুস সাত্তার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করি। কিন্তু সাবেক হুইপ আতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আমাকে জামায়াত ঘরানা ট্যাগ দিয়ে হুমকি প্রদর্শন করেন। এসময় প্রাণভয়ে আমি শেরপুর ছেড়ে দীঘদিন জেলার বাইরে অবস্থান করি। সেই সুযোগে ওই কলেজেরই অসাধু কিছু শিক্ষকের যোগসাজসে আতিউর রহমান আতিক শেরপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড আলহাজ আব্দুস সাত্তার হাসপাতালটি বন্ধ করে দেন। পরে সাবেক হুইপ আতিক তার নিজ এলাকা ভাতশালায় হোমিও কলেজের আগের নাম পরিবর্তন করে আতিউর রহমান হোমিওপ্যাথিক কলেজ নামে আরেকটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
সাবেক এই হুইপের বিরুদ্ধে তিনি প্রায় ৩ কোটি টাকা নিয়োগ বাণিজ্যেরও অভিযোগ আনেন।
তথ্যমতে, আতিকের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এ মামলা হলেও অদৃশ্য কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। রহস্যজনকভাবে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তাকে অব্যাহতি দেয় দুদক।
জানা যায়, শেরপুরে ছাত্র হত্যার আসামি হওয়ায় ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের পর আতিক পরিবারসহ আত্মগোপনে চলে যান।
শেরপুর সদর-১ আসনের বিএনপি থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলটির শেরপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হযরত আলী আতিউর রহমান আতিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, সাবেক হুইপ ও তার দোসররা মিলে আমার বিরুদ্ধে ঢাকা এবং শেরপুরে ৭৫টি মামলা করিয়েছেন। আমার মিল ফ্যাক্টরি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে। আমার মেয়েকে চাকুরিচ্যুত করেছে। আমার নির্বাচনি এলাকার জনগণের পাশে, নিজ বাড়িতে, দলীয় কার্যালয়ে, রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানে এমনকি ঈদেও নিজ এলাকায় আসতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের হয়রানি, গ্রেপ্তার আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দলীয় কার্যক্রম চালাতে হয়েছে।