বেলায় বেলায় তো কম হলো না! ২ দশক কাটিয়ে দিলেন লা মাসিয়ায়। ক্যাম্প ন্যু’য়ের ঘাস-মাঠ আর গ্যালারিজুড়ে কান পাতলেও হয়তো লিওনেল মেসির পদধ্বনি শোনা যাবে!
আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো হেসেখেলে বেড়ে ওঠার সাধটুকু নষ্ট হতে যাচ্ছিলো শৈশবে। দারিদ্র গ্রাস করে রাখা পরিবারের সাধ্য ছিল না স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেয়ার। সেই নিশ্চয়তাটুকু দিয়েছিল বার্সেলোনা। হাতের কাছে পাওয়া ছোট্ট এক টুকরো কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে আর্জেন্টিনার রোজারিও থেকে ১৩ বছর বয়সী কিশোরকে উড়িয়ে আনে ক্লাবটি।
তারপর এই লা মাসিয়ার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠা। এখানকার আলো-বাতাস গায়ে মেখে দাপিয়ে বেড়ানো। বিশ্ব ফুটবলকে পায়ের তলায় নিয়ে আসা। মুকুটবিহীন সম্রাট হয়ে ওঠা। দাপটের সঙ্গে সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করা। সবমিলিয়ে একজন লিওনেল মেসি হয়ে ওঠা। ব্যক্তিই যখন হয়ে ওঠেন গোটা ফুটবলের-দেশের-ক্লাবের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর!
এই যাত্রায় কতোজন সঙ্গী হলেন! আবার ছেড়েও চলে গেছেন। এক লিওনেল মেসিই শুধু রয়ে গেলেন! ক্যারিয়ারের গোধুলী বেলায় এসে হয়তো নিঃসঙ্গতা আঁকড়ে ধরে বিশ্বসেরা ফুটবলারকে!
ছেড়ে যাওয়াদের দলে সবশেষ যুক্ত হলেন লুইস সুয়ারেজ। দুই ল্যাতিন ফুটবলারের অন্তরঙ্গতা সবার জানা কথাই। মাঠের বাইরে দুজনের বন্ধুত্বের খাতিরেই হয়তো, বার্সেলোনা পেয়েছিল সর্বকালের অন্যতম সেরা আক্রমনভাগটা। প্রতিপক্ষকে ছিঁড়েখুড়ে, দুর্ভেদ্য রক্ষণ ভেঙে একের পর এক গোল শেষে, হাসিমুখে ডিনারে বসেছেন একসঙ্গে।
সুয়ারেজের ক্লাব ছাড়ার পর লিও’র হতাশা, রাগ-ক্ষোভ সব টের পাওয়া গেছে তার কথায়। স্বলভাষী মেসি ফাটালেন বোমা। সাধারণত ঠান্ডা মেজাজ আর নির্লিপ্ত মনোভাবের ক্ষুদে জাদুকর তার রাগ-ক্ষোভ সব উগরে দিয়েছেন বন্ধুর জন্য। তাকে যে কতোটা মিস করবেন, বন্ধুবিহীন একাকীত্বের যন্ত্রণা কতোটা ভোগাবে সবই তুলে ধরেছেন নিজের ভাষায়।
কেবল সুয়ারেজ? তার আগেও বন্ধু হারানোর শোক সইতে হয়েছে মেসিকে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের ফুটবলার নেইমারের সঙ্গে বেশ সখ্যতা ছিল তার। বয়সে অনেক ছোট বটে, তবে দু’জনের রসায়নটা বেশ জমেছিল। ২০১৭ সালে বার্সা ছেড়ে নেইমার পিএসজিতে যোগ দেয়ার পরও মুখ খুলেছিলেন মেসি। বারবার ক্লাব কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, যে কোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনা হোক প্রিয় সঙ্গীকে। নেইমার বিহীন তিন মৌসুমে প্রতিবারই কাতালানদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, একজন নেইমারের অভাবের কথা। নেইমারও নানা সময়ে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করেছেন আর ফিরতে চেয়েছিলেন লিওনেল মেসির বাহুডোরে।
বার্সেলোনায় মেসির আরেকজন খুব কাছের বন্ধু ছিলেন সেস্ক ফ্যাব্রিগাস। স্প্যানিশ এই তারকার সঙ্গে বার্সার যুব দল থেকেই খাতির তার। ২০১৪ সালে বার্সা ছেড়ে চেলসিতে যোগ দেন এই মিডফিল্ডার। আর ফেরেননি।
চলতি মৌসুমেই মেসির আরেক বন্ধু আরতুরো ভিদালও ছেড়ে গেছেন তাকে। বলা চলে, সুয়ারেজের মতোই অনেকটা বাধ্য হয়ে বার্সা ছেড়েছেন। ল্যাতিন এই ফুটবলারের বিদায়ের দিনেও বেশ আবেগী বার্তা জানিয়েছেন মেসি।
এর আগে আরো কতো কিংবদন্তির পাশে এক কাতারে দাঁড়িয়েছেন মেসি! শেয়ার করেছেন ড্রেসিংরুম। ছোট্ট মেসিকে সযতনে আগলে রেখেছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদিনহো। চোখ বন্ধ করে ভরসা করতেন আর্জেন্টাইনকে। কার্লোস পুয়োল-জাভি হার্নান্দেজ-ইনিয়েস্তা সবার সঙ্গেই মেসির ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। যাদের পাশে থেকে মেসি শিখেছেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে।
কেবল সতীর্থরাই নন, মেসিকে ছেড়ে গেছেন তার প্রিয় কোচ-সংগঠকরাও। পেশাদার জীবনে একজন কোচকে বেছে নিতে বললে হয়তো পেপ গার্দিওলাকে বেছে নিবেন এই জাদুকর। তার হাত ধরে একের পর এক ট্রফি উঠেছে বার্সার শোকেসে। লিওনেল মেসির হাতে উঠেছে হ্যাটট্রিক ব্যালন ডি অর। হয়ে উঠেছেন বিশ্বসেরা। ২০১২ সালে হুট করেই, সাফল্যের চূড়ায় বসেই বার্সাকে বিদায় বলে দেন গার্দিওলা।
এরপর কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দের সঙ্গেও বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল মেসির। তাকেও বেশ বাজেভাবে বিদায় করে দেয় বার্সা কর্তৃপক্ষ। সেবারও ক্লাবের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন মেসি।
হোসে মারিয়া বার্তোমিউয়ের নেতৃত্বাধীন বার্সার বর্তমান কমিটির সমালোচনার ক্ষেত্রেও কোনো রাখঢাক করেননি মেসি। আর্জেন্টাইন তারকা নিশ্চয়ই মিস করেন হুয়ান ল্যাপোর্তাকে। বার্সার সাবেক এই সভাপতি সবসময়ই আগলে রাখতেন মেসিকে। সুসময়ে যেমন লিও’র পক্ষে হাততালি দিয়েছেন, বিপদের দিনেও দিয়ে গেছেন ছায়া।
লিওনেল মেসি বহুভাষী নন। মাতৃভাষা স্প্যানিশেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। বাংলা জানলে হয়তো বার্সেলোনায় নিজের বিলাসবহুল বাড়ির বেলকনিতে বসে মান্না দে’র বিখ্যাত কফি হাউজ গানটা শুনতেন আর গুনগুন করে গাইতেন, কতো জন এলো গেলো, কতোজনই আসবে, কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়। লিওনেল মেসির ন্যু ক্যাম্প যে সেই কফি হাউজেরই প্রতিচ্ছবি!