দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত খেলা শ্যুটিং। এ ইভেন্ট থেকে শ্যুটাররা দেশের জন্য বয়ে এনেছেন অনেক সুনাম, বহু পুরস্কারও। যে শ্যুটিং দিয়ে আতিক-নিনি-রিংকিং-সাবরিনা-আসিফ-বাকী বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পতকা উঁচিয়ে ধরেছেন। সেই শ্যুটিংয়ের আজ বেহাল দশা। বাংলাদেশ শ্যুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের নামে আসছে অবৈধ অস্ত্র। হিসাব নেই গুলিরও। ফেডারেশনে চলছে হরিলুট। আর তাই তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল ফেডারেশন। তদন্তে উঠে এসেছে ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর নাম।
সভাপতি-মহাসচিবের দ্বন্দ্ব:
দেশে অস্ত্র আনা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের মুখোমুখি হতে হয়েছে শ্যুটারদের। বাংলাদেশ শ্যুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। শ্যুটাররা মনে করেন সভাপতি-মহাসচিবের দ্বন্দ্বের কারণে শ্যুটিংয়ের আজ এ বেহাল অবস্থা।
অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন:
বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সম্মতিতে সরকারের যুগ্ম সচিব হোসনে আরা বেগম, পুলিশের প্রথম মহিলা ডিআইজি ইয়াসমিন গফুর ও ফেডারেশনের যুগ্ম মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটি ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর বিপক্ষে অসংখ্য অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছে। তাতে বলা হয়, নির্বাহী কমিটির বৈঠক ছাড়া এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেডারেশনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তিনি। সে কারণে দেশের শ্যুটিং মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
তদন্ত রিপোর্টে যা বলা হয়েছে:
প্রায় পাঁচ মাস ধরে এই কমিটি তদন্ত শেষে ফেডারেশনের সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়, অস্ত্র ও গুলি আমদানি করতে নির্বাহী কমিটিকে না জানিয়ে দেশের বিভিন্ন রাইফেল ক্লাব ও শ্যুটিং ক্লাব থেকে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছেন। যা অন্য খাতে ব্যয় করেছেন। অস্ত্র বা গুলি স্টোর ভেরিফিকেশন করা হয় না। তার একটি তালাবদ্ধ ট্রাংক ফেডারেশনের স্টোরে থাকলেও এর মধ্যে কি আছে তার কোনো তালিকা দেয়া হয়নি।
গঠনতন্ত্র বহির্ভূতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে কাগজপত্রবিহীন অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। মহাসচিবের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ডেলকো বিজনেস এসোসিয়েটসের মাধ্যমে ১০ মিটার রেঞ্জের আধুনিকায়নে ১০টি ইলেক্ট্রনিক টার্গেট চেঞ্জার ক্রয়ে এক কোটি ৯০ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। শ্যুটিং ফেডারেশনে বসানো প্রতিটি চেঞ্জারের মূল্য ধরা হয়েছে ২৬ লাখ টাকা। একই চেঞ্জার ফের বসানো হয়েছে ৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকায়।
অবৈধভাবে দেশে অস্ত্র আমদানি:
তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, জাতীয় শ্যুটাররা বিদেশ থেকে দেশের ফেরার পথে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের সঙ্গে নতুন অস্ত্র ক্রয় করে আনেন। এসব অস্ত্র শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা হয় এবং পরবর্তীতে এসব অস্ত্র অন্যের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা হয়।
গত বছরের ডিসেম্বরে নেপালে অনুষ্ঠিত ১৩তম সাউথ এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণকারী শ্যুটাররা ওয়ালথার কোম্পানির এলজি ৪০০ মডেলের কেবিএ ৫৭৯৯, কেবিএ ২৭৩২, কেবিএ ২২৩৪ ও কেবিএ ৮৫৯১ সিরিয়ালের ৪টি এয়ার রাইফেল দিয়ে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া গত বছর অনুষ্ঠিত সুজুকি নবম ন্যাশনাল এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণে শ্যুটাররা ওয়ালথার কোম্পানির এলজি ৪০০ মডেলের কেবিএ ২২৪৫, কেবিএ ৩০০০, কেবিএ ২২৩৪ ও কেবিএ ২২৬৯ সিরিয়ালের ৪টি এয়ার রাইফেল দিয়ে অংশগ্রহণ করে যা ফেডারেশন থেকে আমদানি করা হয়নি।
এসব এয়ার রাইফেলের তথ্য শ্যুটিং ফেডারেশনের নথিতে নেই। এসব অস্ত্র আনার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র ও বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতে অস্ত্রগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হতে পারে ধারণা করছেন অনেকেই।
অবৈধ অস্ত্র ক্রেতার বক্তব্য:
তদন্ত রিপোর্টে ফেডারেশন মহাসচিবকে দায়ী করে বলা হয়েছে, শ্যুটিং দলের সঙ্গে আনা এসব অস্ত্র উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। এই সব অস্ত্রের কয়েকজন ক্রেতা তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে জানান, ২০১৭ সালের মে মাসে জার্মানিতে বিশ্বকাপ শেষে ফেরার পথে সাতটি ওয়ালথার এয়ার রাইফেল শ্যুটিং দলের সঙ্গে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করে দেশে নিয়ে আসা হয়।
অস্ত্রের গুদামের রেজিস্ট্রার বইয়ের গড়মিল:
শ্যুটিং ফেডারেশনের অস্ত্রের গুদামের রেজিস্ট্রার বই ও অস্ত্র-গুলি তল্লাশি করে ব্যাপক অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত কমিটি। রেজিস্ট্রার বইয়ে ১ হাজার ১২৮টি লাপুয়া সুপার গুলি রহস্যজনকভাবে অতিরিক্ত হিসাব দেখানো হয়েছে। গুদামের স্টক রেজিস্ট্রার বইয়ে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ ১২ বোরের ৪০টি গুলি বিক্রি দেখানো হয়েছে। এই গুলি বিক্রির কোনো রশিদ স্টক রেজিস্ট্রার বইয়ে লিপিবদ্ধ নেই।
২০১৭ সালের রেজিস্ট্রার বই অনুযায়ী আর সিও স্পেশাল ৩৩ গ্রাম ওজনের ২০টি ও আর সিও স্পেশাল ৪২ গ্রাম ওজনের ৭৫টি গুলির হিসাব নেই। তদন্ত কমিটি গুদামের স্টক রেজিস্ট্রার বইয়ে অস্ত্র ও গুলির হিসাবে নয়-ছয় করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। বিগত কয়েক বছরে ফেডারেশনের যাবতীয় ঠিকাদারি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, পুরাতন এসি লাগিয়ে নতুন এসির মূল্য নেয়া, ফেসবুক পরিচালনায় ২৫ লাখ টাকা তোলা হয়েছে।
আপত্তি স্বত্ত্বেও জার্মানিতে প্রশিক্ষণ:
প্রশিক্ষণ কমিটির আপত্তি থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে বারবার জার্মানিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়- মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপু জার্মানির কোম্পানি ওয়ালথার ও মেরিনো কোম্পানির বাংলাদেশের এজেন্ট। আর তাই বারবার জার্মানীতে নিজের পছন্দের শ্যুটারদের প্রশিক্ষণে পাঠান। এমনটাও অভিযোগ রয়েছে যে মূলত রাইফেল আনার জন্যই বারবার জার্মানিতে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়।
নির্বাহী কমিটির অনুমোদন না নিয়ে এশিয়ান শ্যুটিং কনফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির নির্বাচনে প্রার্থিতা দাখিল করেছেন। আবার নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে এ পি এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম করেনি।
অদৃশ্য শক্তির প্রভাব:
৫০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টে এমন আরো অনেক অনিয়ম আছে মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর নামে। তারপরও কোনো এক অদৃশ্য শক্তির বলে বহাল তবিয়াতে শ্যুটিং ফেডারেশনে অবস্থান করেছেন তিনি। এমনকি শোনা যাচ্ছে তিনি নির্বাচিত কমিটি ভেঙে এডহক কমিটি গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
হুমকিতে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা:
সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার অস্ত্র ও গুলির হিসাব। যা জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। দেশের যত অবৈধ কাজ আছে তার উৎসই অস্ত্র ও গুলি। এগুলো যদি বেহাত হয়ে যায় বা মানুষের হাতে অবৈধ পথে আসে তা দেশ বা রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সভাপতির মন্তব্য:
তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে শ্যুটিং ফেডারেশনের সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেয়েছি। রিপোর্টটি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া অস্ত্র ও গুলির বিষয়ে তদন্ত রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করি মন্ত্রণালয় রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
সব অভিযোগ অস্বীকার মহাসচিবের:
যার বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ শ্যুটিং ফেডারেশনের সেই মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর নম্বরে কল আর এসএমএস করলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। যদিও তার কল না ধরার ব্যপারটা গণমাধ্যমে বেশ প্রচলিত। তবে তদন্তের বিষয়ে তদন্ত কমিটি মহাসচিবের কাছে বক্তব্য চাইলে অনেক জলঘোলা করে ৪ পৃষ্ঠার একটি বক্তব্য তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেন যা ডেইলি বাংলাদেশের কাছে এসেছে। সেখানে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার বিরুদ্ধে ১০টি পয়েন্টের তদন্তে সে নিজের মতো করে একটা ব্যাখা দিয়েছেন। যা তদন্ত কমিটি সভাপতির কাছে জমা দিয়েছেন।